প্রতারকের পরিকল্পনায় শিক্ষক বাবাকে নির্যাতন ও থানায় ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির মামলা

রঘুনাথ খাঁ: প্রতারকের পরিকল্পনায় শিক্ষক সুভাষ দাসকে নির্যাতন ও পাঁচদিন পর থানায় ডেকে নিয়ে চতুর্থ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে দিয়ে শ্লীলতাহানির মামলার প্রতিবাদ ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সস্মেলন করেন তালা উপজেলার নুরুল্লাহপুর গ্রামের সুভাষ চন্দ্র দাসের মেয়ে রমা রাণী দাস।
রমা রানী দাস বলেন, ঠাকুরদাদা নিতাই দাসের দান করা এক বিঘা জমিতে ১৯৭৮ সালে তার বাবা সুভাষ দাস ফতেপুর রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে তাতে শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০১৩ সালে ওই বিদ্যালয়টির সরকারিকরণ করা হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তার বাবা ২০২১ সাল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০২৩ সালে প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম অন্যত্র বদলী হয়ে যাওয়ার পর জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ফতেপুর গ্রামের ইষ্টম দাস ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তিনি(রমা) দুই বার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক নিয়োগের ভাইপা পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন। বিশেষ ব্যবস্থায় এক সপ্তাহের মধ্যে চাকুরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ১৫ লাখ টাকা ঘুষের চুক্তিতে তার কাথ থেকে ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রথমে এক লাখ টাকা নেন ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইস্টম দাস।এক সপ্তাহের মধ্যে চাকুরি দেওয়া না হলে টাকা সুদাসলে ফেরৎ দেওয়ার নিশ্চয়তা দেন ইষ্টম দাস। চাকুরি না হওয়ায় টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ করায় ইষ্টম ও তার স্ত্রী অঞ্জলী দাসের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। একপর্যায়ে গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর তাকে ৫০ হাজার টাকা ফেরৎ দেন ইষ্টম দাস। নিজের চিকিৎসার জন্য টাকা ফেরৎ দিতে বলায় তার বাবা ও পরিবারের সদস্যদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেন ইষ্টম দাস ও তার স্ত্রী অঞ্জলি দাস।। রমা দাস লিখিত আরো বলেন, গত ১০ মার্চ রবিবার সকাল সাড়ে ৯টায় বিদ্যালয়ের মাঠে পৌঁছানোর পর তার বাবাকে অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে যান প্রতিবেশি প্রদীপ দাসের ছেলে ও ইষ্টম দাসের সুশ্রী স্ত্রীর ঘনিষ্ট বলে পরিচিত আকাশ দাস। এরপরপরই দরজা আটকে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইষ্টম দাসের ইন্ধনে বাবাকে বেধরড়ক পেটান আকাশ দাস। ইষ্টম দাসের কাছে টাকা চাওয়ার সাধ মিটিয়ে দেব, ধর্ষণ মামলা দেবো এমন কথা বলতে বলতে পাঁচ মিনিট ব্যাপি মারপিটের ফলে চশমার ফ্রেম ভেঙে চোখের কোনে ও নাকের উপরে ঢুকে রক্তাক্ত জখম হন বাবা। এরপরপরই সেখানে হাজির হন বিকাশ দাস। দরজা খুলে আকাশ দাস বেরিয়ে আসলে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে স্থানীয় সহকারি শিক্ষক সাঈদা খানম, মা ছায়া রানী দাসহ স্থানীয়রা বিদ্যালয়ে ছুটে এসে ঘটনা জেনে প্রতিবাদ করেন। । এতে ক্ষুব্ধ আকাশ ও তার ভাই বিকাশ দাস বাঁশের লাঠি নিয়ে বাবা ও মা ছায়া রানীকে মারতে যান। এরপর বাবা বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি সূর্যপদ পালকে অবহিত করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। পরদিন ১১ মার্চ বাবা থানায় ৪২৯ নং সাধারণ ডায়েরী করেন। গত ১৫ মার্চ শুক্রবার রাত ১২টার পরে পুলিশ বাড়ি থেকে বাবাকে ডেকে থানায় নিয়ে পরদিন আকাশ দাসের শিশু কণ্যাকে গত ৭ মার্চ দুপুর সোয়া ১২টায় বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে শ্লীলতাহানির অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়। বাবাকে পরিকল্পিত ও মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারের নেপথ্যে ভ‚মিকা পালন করেছে আকাশ দাসের ছোট ভাই কক্সবাজারে টেকনাফ থানার আর্মস ব্যাটালিয়ন পুলিশে কর্মরত সহকারি উপপরিদর্শক প্রকাশ দাস।
রমা রানী দাস জানান, ৯ মার্চ গোপালপুর বলাই ঘোষের আমবাগানে পিকনিক উপলক্ষে ৭ মার্চ থেকে গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালেয় কারিকুলাম উন্নয়নের জন্য ‘উত্তরণ’ নাটকের রিহার্সাল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। সে অনুযায়ি ৭ মার্চ বাবা বিদ্যালয়ে সাড়ে ৯টায় হাজিরা দিয়ে সকাল ১০টার দিকে বের হয়ে সাড়ে ১০টায় গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসেন। সেখানে রিহার্সাল চলাকালে ইসলামকাটি আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এনামুল হক, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি সূর্যপদ পালসহ ২৬ জন শিক্ষক বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। এরপরও বাবাকে ইস্টম দাসের পরিকল্পনায় আকাশ দাসের মেয়েকে দিয়ে মিথ্যা ও পরিকল্পিত মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। ওই দিন গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকা সংক্রান্ত ভিডিও এবং স্থির চিত্র রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে নিরাপরাধ বাবার নিঃশর্ত মুক্তি, ইষ্টম দাসের কাছে পাওনা ৫০ হাজার টাকা ঘুষের টাকা ফেরৎ ও বাবার উপর হামলাকারি ও মিথ্যা মামলা দায়েরর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারসহ বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রমা রানী দাসের মা ছায়া রানী দাস।
ইসলামকাটি সরকারি আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এনামুল হক বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ি গত ৯ মার্চ বলাই ঘোষের আমবাগানে পিকনিক অনুষ্ঠানে “উত্তরণ” নাটক মঞ্চস্ত করার অংশ হিসেবে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশে তিনি, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি সূর্যপদ পাল ও সুভাষ দাসসহ ২৬ জন শিক্ষক ৭ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত গোপালপুর সরকারি বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন।
গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক সাঈদা খানম জানান, ঘটনার সময় ও তারিখে গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রিহার্সালে থাকার পরও সুভাষ স্যারকে নির্যাতনের পর মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে ইষ্টম দাস বলেন, সুভাষ দাসকে বাঁচাতে তার মেয়ে রমা রাণী দাস সংবাদ সস্মেলনে বাদিসহ তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছে। তবে ৭ মার্চ সুভাষ দাস সঠিক কোন সময়ে বিদ্যালয় থেকে গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন সেটা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়।
তালা উপজেলা সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা অসীম কুমার সরকার বলেন, ১০ মার্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতিতে অভিভাবক আকাশ দাস মারপিট করার বিষয়টি তাকেও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে জানান সুভাষ দাস। ১২ মার্চ আকাশ দাস ত ার মেয়েকে শ্লীলতাহানির করা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে অভিযোগ দিলে পরদিন তারা ঘটনাস্থলে যান। সুভাষ দাস গোপালপুর সরকাাির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কখন গিয়েছিলেন এমন প্রশ্নের জবারে প্রধান শিক্ষক বলেছিলেন ৭ মার্চ ১০টার পরপরই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সুভাষ দাস সকাল ১০ টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে ছিলেন মর্মে লিখিত দেওয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে ৭ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত সুভাষ দাস গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রিহার্সালে ছিলেন বলে সেখানে উপস্থিত দলনেতা শিক্ষক এনামুল হকসহ বেশ কয়েকজন তাদের কাছে শিক্ষক লিখিত দিয়েছেন।
তালা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি সূর্যপদ পাল বলেন, তিনি এবং সুভাষ দাসসহ ২৬ জন শিক্ষক ৭ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকলেন আর ওইদিন দুপুর সোয়া ১২টায় চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রীর বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে ডেকে শ্লীলতাহানির ঘটনা পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এ ছাড়া কোনরুপ অভিযোগ না করে কর্মরত অবস্থায় অফিসককক্ষে ডেকে সুভাষ দাসকে মারপিট মেনে নেওয়া যায় না।
তালা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গাজী সাইফুল ইসলামের সঙ্গে তার মুঠোফোনে মঙ্গলবার বিকেলে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তালা থানার উপপরিদর্শক ও মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান জানান, ঘটনার যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)