প্রেমের ফাঁদে ফেলে মা ও শিশু সন্তানকে ভারতে পাচারের চেষ্টা

রঘুনাথ খাঁঃ সাড়ে পাঁচ বছরের এক শিশুসহ মাকে ফুসলিয়ে ভারতে পাচার করার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার কুশুলিয়া গ্রামের নারীলোভী প্রতারক অলোক কুমার মÐল ওরফে বাপ্পির বিরুদ্ধে। বিষয়টি ওই নারীর বাবাকে অবহিত করানোয় নিজের মামা পবিত্র মÐলের উপর নির্যাতন ও নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে বাপ্পির বিরুদ্ধে।
তবে নারীলোভী বাপ্পির হাত থেকে মা ও শিশু উদ্ধার হলেও গৃহকর্তা ও কতিপয় সুবিধাভোগীর সহযোগিতায় বহাল তবিয়তে রয়েছেন বাপ্পি। বাপ্পি কুশুলিয়া গ্রামের সঞ্জিত মÐলের ছেলে।
কালিগঞ্জের কুশুলিয়া গ্রামের বিমল বিশ্বাসের ছেলে শশী বিশ্বাস জানান, উপজেলার বেনাদনা গ্রামের মনোরঞ্জন মÐলের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী নিপাকে প্রায় তিন বছর আগে কলেজে পড়াশুনাকরাকালিন ফুসলিয়ে বিয়ে করে ইজিবাইব চালক একই গ্রামের অলোক মÐল ওরফে বাপ্পি। মা অর্চনা মÐল, ভগ্নিপতি অলোক ও তার ব্যবসায়িক অংশীদার সুশান্ত মÐল ওরফে ফক্কু পরামর্শে নিপার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ও সোনার গহনা লুট শেষে নির্যাতন শুরু করায় বাপের বাড়ি কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের সোতা গ্রামে যেয়ে বাপ্পিকে ডিভোর্স দেয় নিপা। বর্তমানে নিপা অন্যত্র ঘর সংসার করছে।
শশী বিশ্বাস আরো জানান, আড়াই বছর আগে বাড়ির সামনে সরকারি রাস্তার পার্শে নর্দমা খোড়ার কারণে তিন দিন তার ইজিবাইকের ব্যটারী চার্জ দেওযার জন্য তার সহায়তা চায় অলোক মÐল ওরফে বাপ্পি। তিনি আপত্তি না করায় কৌশলে তার(শশী) স্ত্রী পম্পার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। একপর্যায়ে একদিন সন্ধ্যায় পম্পার সাথে অনৈতিক সম্পর্কের সময় বাথরুম থেকে ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যায় বাপ্পি। জয়পত্রকাটি গ্রামের উত্তম বৈদ্যের বাড়িতে এক শালিসি বৈঠকের মাধ্যমে শ্বশুর আশাশুনি উপজেলার সোদকোনা গ্রামের সাধন তরফদারের মুচলেকায় পম্পাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। গত ২ জানুয়ারি পম্পা সাড়ে পাঁচ বছরের ঈশান বিশ্বাসকে সাথে নিয়ে বাপের বাড়ি যায় পম্পা। ১০ জানুয়ারি নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে তৈরি পম্পার সাক্ষর করা একটি তালাকনামা পান তিনি। ২১ জানুয়ারি তার (শশী) জ্যাঠামহাশয় তুলশী বিশ্বাসের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে আসার কথা বলে বাপের বাড়ি সোদকোনা থেকে কুশুলিয়াতে আসার কথা বলে বের হয় পম্পা। কুশুলিয়াতে না আসার খবর পেয়ে তিনি (শশী) কালিগঞ্জ থানায় গেলে ঘটনাস্থল আশাশুনি থানাধীন হওয়ায় সেখানে ডায়েরী করার পরামর্শ দেন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ শাহীন। একপর্যায়ে সাধন তরফদার ২২ জানুয়ারি মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে সাধারণ ডায়েরী করেন। পরবর্তীতে ২৪ জানুয়ারি বুধবার সন্ধ্যায় বাপ্পির ভগ্নিপতির বন্ধু সুশান্ত মÐল ফক্কু তার বাবা বিমল বিশ্বাসকে জানান যে, পম্পাকে ছেলেসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগর নিয়ে যাবে বাপ্পি। পরদিন ২৫ জানুয়ারি বৃহষ্পতিবার দুপুরে শ্বশুর সাধন তরফদারের কাছ থেকে ফোনে জানতে পারেন যে তার একমাত্র ছেলে ঈশান বিশ্বাসকে নির্যাতন করে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে ডুমুরিয়ার পিসতুতো ভগ্নিপতি ওই শিশুকে দাদুর বাড়িতে এনেছে। পম্পার সন্ধান পেতে বাপ্পির পিসতুতো ভগ্নিপতিকে বেধড়ক পেটায় সাধন তরফদার ও তার স্বজনরা। এ সময় স্থানীয়রা জানতে পারেন যে বাপ্পি তার ছোট মাসি পাটকেলঘাটার কাটাখালি গ্রামের চন্দনার বাড়িতে পম্পা ও তার ছেলেকে দুদিন রেখে ডুমুরিয়ার পিসতুতো ভগ্নিপতির কাছে চলে যায়। সেখানে বাচ্চাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করলে ওই ভগ্নিপতি ওই বাচ্চাকে রাখতে সোদকোনার সাধন তরফদারের বাড়িতে আসেন। সেখান থেকে মার খেয়ে তিনদিনের মধ্যে পম্পাকে ফিরিয়ে দেওয়ার মর্তে মুক্তি পায় ওই ভগ্নিপতি। ২৫ জানুয়ারি রাতে বাড়ি ফিরে বাপ্পি ও পম্পাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় ওই ভগ্নিপতি। একপর্যায়ে ছোট মামা পবিত্র মÐলের বাড়িওয়ালা পাটকলেঘাটার কুমিরা ঠাকুরপাড়ার সাধন ভট্টাচার্যের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয় বাপ্পি ও পম্পা। বিষয়টি কৌশলে পম্পার বাবা সাধন তরফদারকে মোবাইলে অবহিত করলে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ২৮ মার্চ পম্পাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান সাধন তরফদার।
পবিত্র মÐলের স্ত্রী শিল্পী ঘোষ জানান, পম্পাকে তার বাবার হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষোভে বাড়িওয়ালা সাধন ভট্টাচার্যের পরামর্শে অলোক মÐল ওরফে বাপ্পি তার মা অর্চনা মÐলকে দিয়ে সুসম্পর্ক না থাকা ছোট মামার কাছে নগদ দুই লাখ টাকা ও পম্পার আড়াই ভরি সোনার গহনা রেখে দিয়েছে মর্মে ১১ মার্চ থানায় একটি অভিযোগ করায়। অভিযোগের তদন্তভার পান উপপরিদর্শক গোপাল চন্দ্র বৈদ্য। রাতে ৮টার দিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে(পরিবহন কাউন্টিার কাম বিকাশ এজেন্ট) যেয়ে তার স্বামী পবিত্রকে পরদিন সকাল ১০টায় থানায় যেতে বলেন গোপাল বৈদ্য। এর কিছুক্ষণ পর তদন্তকারি কর্মকর্তা গোপাল বেদ্য, রাঢ়ীপাড়ার আওয়ামীলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম, কুমিরার গোপাল ঘোষ, বাড়িওয়ালা সাধন ভট্টাচার্য এবং ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া মিলন কর্মকার ও ভগবতী কর্মকার দম্পতির যোগসাজস করে পবিত্রকে বাসায় নিয়ে দরজা খুলতে বাধ্য করে । গোপাল বৈদ্য তার স্বামীকে অর্চনা মÐলের অভিযোগে উল্লেখিত টাকা ও সোনার গহণা দেওয়ার জন্য মারপিট করতে থাকে। একপর্যায়ে শোকেসের গøাস ভেঙে রফিকুল ইসলাম পাটকেলঘাটা জনতা ব্যাংকের শাখার হিসাব নম্বরের তিনটি চেকের পাতায় স্বামীর কাছ থেকে সাক্ষর করে নেন। নেওয়া হয় তার ও স্বামীসহ তিনজনের জাতীয় পরিচয়পত্র। এর কিছুক্ষণ পর ১০০ টাকার তিনটি অলিখিত নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে সাক্ষর করিয়ে নেন রফিকুল। স্বামীকে ঘর থেকে বাহিরে ও বাইরে থেকে ঘরে নেওয়ার একপর্যায়ে বাড়িওয়ালা সাধন ভট্টাচার্য তার স্বামীর ব্যাগে থাকা বিকাশ এজেন্টের এক লাখ টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেন। পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে টাকা ও সোনার গহনা ফিরিয়ে না দিলে ফল ভাল হবে না বলে স্বামীকে হুমকি দিয়ে চলে যান গোপাল বৈদ্যসহ অন্যরা। এরপর থেকে বাড়িওয়ালা ঘরের দরজার বাইরে থেকে তালা মেরে অপূর্বকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। রাতে বাপের বাড়ি থেকে এসে বাড়িওয়ালাকে বারবার অনুরোধ করলেও রাতের খাওয়ার টুকু পর্যন্ত পবিত্রকে দিতে পারেননি তিনি। বাধ্য হয়ে তিনি ১২ মার্চ পাটকেলঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ করেন তিনি। উপপরিদর্শক গোপাল বৈদ্যর বিরুদ্ধে অপূর্বকে মারপিটের অভিযোগ করার ক্ষুব্ধ হন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার নাথ। একপর্যায়ে বাড়িওয়ালা, রফিকুল ও পবিত্রকে থানায় হাজির করানো হয়। আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম অপূর্ব স্বাক্ষরিত তিনটি নন জুডিশিয়াল স্টাম্প, তিনটি চেক ও তিনটি জাতীয় পরিচয়পত্র ফিরিয়ে দেন। এ সময় রফিকুল ইসলাম নিশ্চিত করেন যে খারাপ আচরণের জন্য গোপাল বৈদ্য তার স্বামী পবিত্রকে সজোরে গালে একটি থাপ্পড় মেরেছিলেন। গোপাল বৈদ্যকে অর্চনার পাওনা টাকা ও সোনার গহনা সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার । একপর্যায়ে গৃহকর্তা সাধন ভট্টাচার্যের কাছে থাকা ব্যাগ থেকে চুরি করা এক লাখ টাকা না পেলেও থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পরামর্শে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়। পরে পবিত্রকে নিয়ে সাতক্ষীরার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরদিন তাদের ভাড়া নেওয়া ঘরের মালপত্রসহ সাধন ভট্টাচার্য তালা মেরে অর্চনার সঙ্গে আপোষ করে নিতে বলেন। নইলে মালামাল না দিয়ে রবিবার আদালতে মামলা করার হুমকি দেন সাধন ভট্টাচার্য। বিষয়টি নিয়ে ১৩ ,১৪ ও ১৫ মার্চ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা ও তার অফিসে যেয়ে দেখা করতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে অমর মন্লড বলেন, তার ভাগ্নে অলোককে বিদশে পাঠাতে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিলেও তা আজো পরিশোধ করেনি সে। অথচ একের পর এক নারী কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়েছে সে। এসব কারণে ছোট ভাই পবির্ত্র ও তার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না দিদি অর্চনা ও অলোকের। এখন প্রতিশোধ নিতে ছোট মামাকে মাকে দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে অলোক। এত সহযোগি হিসেবে কাজ করছে বাড়িওয়ালাসহ স্থানীয় একটি দালাল চক্র। আইনি প্রক্রিয়ায় ওই অশুভ শক্তির হাত থেকে ভাইকে রক্ষা করতে চান তিনি।
সাড়ে পাঁচ বছরের ঈশান বিশা¦াস বলে, মায়ের সঙ্গে অলোক খাটে ঘুমাতো কাটাখালি ও ডুমুরিয়ায়। ঠাÐায় তাকে মেঝেতে ফেলে রেখে দিয়ে দূর থেকে বিস্কুট ছুঁড়ে দেওয়া হতো। একদিন তাকে মারতে মারতে মেরে ফেলার চেষ্টা করায় ডুমুরিয়ার বাড়িওয়ালা তাকে দাদুর বাড়িতে নিয়ে রেখে আসে। তবে দাদুর বাড়িতে তাকে মারা ঠিক হয়নি। এখন সে বাবা, ঠাকুরদাদা ও ঠাকুর মার কাছে তাকতে চায় সে।
অর্চনা মÐল জানান, তার ছেলে পম্পাকে বিয়ে করে প্রথমে তার ছোট বোন চন্দনা, পরে পিসতুতো ভগ্নিপতির বাসা ও পরে ছোট মামার বাড়িওয়ালার বাসায় নিয়ে রাখে। তবে আট মাস আগে একটি এনজিও থেকে তোলা দুই লাখ টাকা নিয়ে দুই মাস আগে বাড়ি থেকে চলে যায় অলোক। অলোক ওই টাকা ও পম্পার গহনা পবিত্র’র কাছে দিয়েছে বলায় বাড়িওয়ালার পরামর্শে তিনি থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। এর আগেও নিপা নামের এক স্বামী পরিত্যক্তাকে অলোক বিয়ে করেছিল নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ভাল না লাগায় নিপা বাপের বাড়ি যেয়ে ডিভোর্স দিয়েছে।
অলোক কুমার মÐল বাপ্পি জানান, কাকে বিয়ে করবেন আর কাকে ছাড়বেন, কোথায় থাকবেন এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
কুমিরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ও গোপাল ঘোষ বলেন, ১১ মার্চ রাত ১০টার দিকে ২০/৩০ জন লোকের সামনে উপপরিদর্শক গোপাল বৈদ্যের উপস্থিতি স্বেচ্ছায় পবিত্র মÐল স্ট্যাম্প ও চেকের পাতায় সই করে দিয়েছে। কথা না শোনায় গোপাল বৈদ্য এক থাপ্পড় মেরেছিলেন পবিত্রকে।
পাটকেলঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার নাথ গত ১২ মার্চ দুপুরে এ প্রতিবেদককে বলেন, উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটনায় অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে শিল্পী ঘোষ। তবে পবিত্র মÐলের মালামাল বাড়িওয়ালা কর্তৃক ঘরে তালা মেরে রাখার ব্যাপারে ১৩ মার্চ সকাল সাড়ে ১১টায় জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবেন না বলে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)