সাতক্ষীরা সদর থানা লকআপ থেকে সাত বছর আগে নিখোঁজ ডাঃ মোখলেছুর রহমান!

রঘুনাথ খাঁ,সাতক্ষীরা:

সাত বছর আগে সাতক্ষীরা সদর থানা লকআপ থেকে শহরের পারকুকরালির হোমিও চিকিৎসক ডাঃ মোখলেছুর রহমান জনি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় তার বাবা শেখ আব্দুর রাসেদের আদালতে দায়েরকৃত অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুমের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে গোয়েন্দা, অপরাধ ও তদন্ত শাখা (সিআইডি)। সংস্থাটির পুলিশ পরিদর্শক মোঃ হারুণ অর রশিদ সম্প্রতি সাতক্ষীরার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে এ প্রতিবেদন দাখিল করেন। বিচারক মোঃ জিয়াউল হক আগামি ২৫ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য দিন ধার্য করেছেন।

মামলায় আসামীরা হলেন, পিরোজপুর জেলা সদরের পিরোজপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ শেখের ছেলে সাতক্ষীরা সদর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ এমদাদুল হক শেখ, গোপালগঞ্জ জেলা সদরের করপাড়া গ্রামের আব্দৃল কাদের মোল্লার ছেলে ও সাতক্ষীরা সদর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন মোল্লা এবং নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানার পাংখাচর গ্রামের মোঃ সাঈদুর রহমানের ছেলে ও সাতক্ষীরা সদর থানার সাবেক উপপরিদর্শক মোঃ হিমেল হোসেন।

মামলা ও ঘটনার বিবরনে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে অসুস্থ বাবার জন্য বাইসাইকেলে ঔষধ কিনতে যেয়ে সাতক্ষীরা শহরের লাবনী সিনেমা হলের সামনে ফটোস্টাটের দোকান থেকে সদর থানার উপপরিদর্শক হিমেল শহরের পারকুকরালির শেখ আব্দুর রাশেদ এর ছেলে হোমিও চিকিৎসক মোখলেছুর রহমান জনিকে(২৭) থানায় ধরে নিয়ে যান। ৫,৬ ও ৭ আগষ্ট স্ত্রী জেসমনি নাহার রেশমা তার শ্বশুর, সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ ও স্বজনদের নিয়ে থানা লক আপে তাকে খাবার দিয়েছেন, তার সঙ্গে কথা বলেছেন। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদুল হক শেখ ও উপপরিদর্শক হিমেলের সঙ্গে কথা বললে জনির আল্লাহর দল নামে একটি জঙ্গি সংগঠণের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানানো হয়। স্বামীর মুক্তির বিনিময়ে তৎকালিন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ এমদাদ হোসেন ও উপপরিদর্শক হিমেল জনির স্ত্রী রেশমার কাছে দাবি করেন মোটা অংকের টাকা। টাকা না দিলে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। ৮ আগষ্ট থানায় গেলে জনিকে পাওয়া যায়নি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নেতা, পুলিশ সুপার, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদি দের জানিয়ে কোন লাভ হয়নি। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর পুলিশ সাধারণ ডায়েরী না নেওয়ায় সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি সদর থানায় গেলে মানবাধিকার কর্মী অনির্বাণ সাহা, রঘুনাথ খাঁসহ তিনজনকে সাধারণ ডায়েরী না নিয়ে তিনি কোন অন্যায় করেননি বলে জানান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন মোল্লা। অবশেষে ২০১৭ সালের ২ মার্চ হাইকোর্টে রিট পিটিশন (২৮৩৩/১৭) দাখিল করেন জেসমিন নাহার রেশমা। মামলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আটজনকে বিবাদী করা হয়। পরবর্তীতে আদালত মাখলেছুরকে ওই বছরের ১২ এপ্রিলের মধ্যে সাতক্ষীরার বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ এর পাশাপাশি ৯ মে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ঢাকা লিগ্যাল সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এএসএম জাভিদ হাসানকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তদন্তকালে সাতক্ষীরা সদর থানার তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন মোল্লা নিখোঁজ ডাঃ মোখলেছুর রহমান জনি আল্লার দল নামে একটি জঙ্গী সংগঠণ করতেন বলে লিখিতভাবে উল্লেখ করেন। প্রতিবেদন রিটকারির বিপক্ষে যায়।পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৭ সালের বছরের ৩ জুলাই সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হাবিবুল্লাহ মাহমুদ হাইকোর্টে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে থানা লক আপ থেকে ডাঃ জনির নিখোঁজ হওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। পরবর্তীতে এক আদেশে ওই বছরের ৩ অক্টোবরের মধ্যে এ সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো ইনভেসটিগেশন) নির্দেশ দেওয়া হয়। পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে ডাঃ জনিকে থানায় এনে আটক রাখার সত্যতা মেলেনি বলে উল্লেখ করা হয়। ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে মহামান্য হাইকোর্ট ডাঃ জনি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরী নিয়ে তার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদুল হক শেখ, ফিরোজ হোসেন মোল্ল্যা ও উপপরিদর্শক হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা গ্রহণ ও একইসাথে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা যেতে পারে বলে এক আদেশে উল্লেখ করেন। পরে হিমেল হোসেন বিরুদ্ধে ৬/১৮, ফিরোজ হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে ১৬/২০ ও এমদাদুল হক শেখের বিরুদ্ধে ১৭/২০ নং বিভাগীয় মামলা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গার আইন সহায়তা চেয়ে না পেয়ে বিশিষ্ঠ মানবাধিকার কর্মী মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউÐেশনের চেয়ারপার্সন অ্যাড. সুলতানা কামালের সহায়তায় নিখোঁজ জনি’র বাবা শেখ আব্দুর রাশেদ ২০২১ সালের ১৭ আগষ্ট মঙ্গলবার সাতক্ষীরা মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামী সদর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ এমদাদ হোসেন, ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও উপপরিদর্শক হিমেলের বিরুদ্ধে জনিকে অপহরণ করে হত্যার পর লাশ গুমের অভিযোগ আনা হয়। মামলার নথিতে হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট পিটিশনের আদেশের জাবেদা নকল, রিট পিটিশন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন ও পিবিআই প্রতিবেদনের ছায়ালিপি জমা দেওয়া হয়।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা পুলিশের গোয়েন্দা, অপরাধ ও তদন্ত শাখার পুলিশ পরিদর্শক (সিআইডি) হারুন অর রশিদ গত ২৪ আগষ্ট আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে আসামী হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে ভিকটিম মোখলেছুর রহমান জনিকে ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট রাত ৯টার দিকে শহরের লাবনী মোড় এলাকা থেকে অপহরণ কওে থানা লক আপে তিন দিন আটক রাখার বিষয়টি অস্বীকার করা, ভিকটিমকে ছেড়ে দেওয়ার শর্তে টাকা দাবি করা এবং ভিকটিমের অস্তিত্ব ও অবস্থান গোপন রাখার মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রমান অদৃশ্য করার অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। যাহা পেনাল কোডের ৩৬৪/৩৪৩/৩৮৭/১২০/২০১/৩৪ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একইভাবে আসামী এামদাদুল হক শেখের বিরুদ্ধে ভিকটিম মোখলেছুর রহমান জনিকে শহরের লাবনী মোড় থেকে অপহরণ করে থানা লক আপে তিনদিনের অধিক সময় আটকে রাখা, মুক্তি দেওয়ার শর্তে মোটা অংকের টাকা দাবি করা, টাকা না দিলে ডাঃ মোখলেছুরকে ক্রস ফায়াওে দেওয়া হবে বলে তার স্ত্রী জেসমিনকে হুমকি দেওয়া, আটক থাকা স্বত্বেও রেজিষ্টার ও জিডিতে লিপিবদ্ধ না কওে ভিকটিমের অবস্থান ও অস্তিত্ব ও অবস্থান গোপন রেখে অস্বীকার করার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। যাহা পেনাল কোডের ৩৬৪/৩৪৩/ ৩৮৭/২০১ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আসামী ফিরোজ হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষী জেসমিন নাহারের জিডি গ্রহণ না করা বা অভিযোগ সংক্রান্ত কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না কওে আইনের নির্দেশ অম্যান্য করার অভিযোগ রয়েছে। যাহা পেনাল কোডের ১৬৬ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তবে তদন্তে এটাই বেরিয়ে এসেছে যে, কলারোয়া উপজেলার লাঙ্গলঝাড়া গ্রামে তার শ^াশুড়ির জমি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদেও নামে লিখে নেওয়ার ঘটনায় আদালতে মামলা করানো ও মামলার তদ্বিরকারক হিসেবে ডাঃ মোখলেছুর রহমান সাবেক ইউপি সদস্য তার চাচাতো চাচা শ^শুর ফারুক আহম্মেদ ওরফে ফারুক হাজরার আক্রোশে ছিলেন। ওই সময় কলারোয়া থানায় কর্মরত উপপরিদর্শক হিমেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে সদর থানায় বদলীকৃত উপপরিদর্শক হিমেলের মাধ্যমে ডাঃ মোখলেছুরকে শাস্তির ব্যবস্থা হিসেবে অপহরণ করান। তবে ভিকটিমের অবস্থান সম্পর্কে তদন্তকারি কর্মকর্তা কোন ক্লু উদ্ধার করতে পারেননি।
এ ব্যাপাওে বাদিপক্ষের আইনজীবী জাসদ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. মোসলেমউদ্দিন ও মোঃ ফরহান হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, পুলিশের অপরাধ, তদন্ত ও গোয়েন্দা শাখা আদালতে যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন তাতে ভিকটিম উদ্ধারে কোন নিদ্দিষ্ট পন্থা নেই। মামলাটি সিআর হিসেবে গণ্য হওয়ায় ভিকটিম উদ্ধারে আসামীদেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোন প্রক্রিয়ায় রিমান্ড আবেদন করা যায় তা নিয়ে উচ্চ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সাথে কথা বলবেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)