কলারোয়ায় শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা মামলায় সাক্ষী দেবেন তিন আওয়ামী লীগ নেতা

রঘুনাথ খাঁ:
২০০২ সালের ৩০ আগষ্ট সাতক্ষীরায় কলারোয়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলার অস্ত্র ও বিষ্ফোরক দ্রব্য আইনের দু’টি মামলার সাক্ষী গ্রহণ শুরু হচ্ছে আগামি ১৬ জুন। সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক বিশ্বনাথ মণ্ডল ওই দিন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী মেখ মুজিবুর রহমান, কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন ও সাবেক আহবায়ক সাজেদুর রহমান চৌধুরীর সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন।

ঘটনার বিররণে জানা যায়, ২০০২ সালের ৩০ আগষ্ট সকাল ১০টায় তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা উপজেলার চন্দনপুর ইউনিয়নের হিজলি গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার ধর্ষিতা স্ত্রীকে দেখতে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আসেন। সেখান থেকে যশোরে ফিরে যাওয়ার পথে সকাল ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে কলারোয়া উপজেলা বিএনপি অফিসের সামনে রাস্তার উপর জেলা বিএনপি’র সভাপতি ও তৎকালিন সাংসদ হাবিবুল ইসলামের হাবিব ও বিএনপি নেতা রঞ্জুর নির্দেশে বিএনপি ও যুবদলের নেতা কর্মীরা দলীয় অফিসের সামনে একটি যাত্রীবাহি বাস(সাতক্ষীরা-জ-০৪-০০২৯) রাস্তার উপরে আড় করে দিয়ে তার গাড়ি বহরে হামলা চালায়। হামলায় তৎকালিন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মতিন, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী সাথী ও সাংবাদিকসহ কমপক্ষে এক ডজন দলীয় নেতা কর্মী আহত হয়।

এ ঘটনায় থানা মামলা না নেওয়ায় ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর কলারোয়া মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার মোসলেমউদ্দিন বাদি হয়ে যুবদল নেতা আশরাফ হোসেন, আব্দুল কাদের বাচ্চুসহ ২৭ জনের নাম উলে­খ করে অজ্ঞাতনামা ৭০/৭৫ জনকে সাতক্ষীরা নালিশী আদালত ‘ক’ অ লে একটি মামলা(সিআরপি-১১৭১/০২) দায়ের করেন। মামলায় ১৮জনকে সাক্ষী করা হয়। বিচারক এম আই ছিদ্দিকী তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসএম গোলাম কিবরিয়াকে নির্দেশ দেন। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঘটনা মিথ্যা বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

বারবার তদন্তকারি কর্মকর্তার কাছে যেয়েও তিনি জবানবন্দি না নিয়ে নিজের মনগড়া কথা ১৬১ ধারার জবানবন্দি হিসেবে উলে­খ করেছেন বলে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এফিডেফিড দিয়ে আদালতের কাঠগড়ায় হাজির হয়ে বিচারককে অবহিত করেন সাক্ষী ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন, শওকত হোসেন, শহীদুল ইসলাম, প্রভাষক জাভিদ হাসান, আমিনুল ইসলাম লাল্টু ও আলতাফ হোসেন লালু।

বাদি মোসলেমউদ্দিন পুলিশ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে ২০০৪ সালের ২২ জানুয়ারি আদালতে নারাজির আবেদন জানালে শুনানী শেষে তা খারিজ হয়ে যায়। এ খারিজ আবেদনের বিরুদ্ধে বাদি ২০০৪ সালের ১১ এপ্রিল জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা ( ১৭/০৪) দায়ের করেন। ২২ এপ্রিল শুনানী শেষে বিচারক এ রিভিশন আবেদন খারিজ করে দেন। ২০০৪ সালের ৪ আগষ্ট বাদি এ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে ক্রিমিনাল মিস কেস (৫৮৯৩/০৪) দাখিল করেন। দীর্ঘ শুনানী শেষে বিচারকদ্বয় ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই আপিল মঞ্জুর করে নিম্ন আদালতের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ দেন। একইসাথে নিম্ন আদালতে মামলার কার্যক্রম নতুন করে শুরু করার করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। আদেশের কপি দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় পর ফাইলবন্দি থাকার পর ২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে এসে পৌঁছায়। ১৭ সেপ্টেম্বর বাদির উপস্থিতিতে নারাজির শুনানী করার জন্য মুখ্য বিচারিক হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহা ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর দিন ধার্য করেন। ওই দিন তিনি অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করার জন্য কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। ২০১৫ সালের ১৭ মে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) শফিকুর রহমান ৫০ জনের নাম উলে­খ করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলাটি তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে এসটিসি ২০৭/১৫, এসটিসি ২০৮/১৫ দু’টি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-২য় আদালতে বিচারাধীন। অপর টিআর ১৫১/১৫ মামলাটি ২০২১ সালের ৪ ফেব্র“য়ারি অভিযোগপত্রে উলে­খিত ৫০ জনের বিরুদ্ধে চার থেকে ১০ বছর মেয়াদে সাজা প্রদান করেন। এরমধ্যে আসামী সাবু কারাগারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

২০১৭ সালের ৯ আগষ্ট হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ মিফতাহউদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি এএনএম বসিরউল্লাহ এ আদালতে বিচারাধীন এসটিসি ২০৭/১৫, ২০৮/১৫ দু’টি এসটিসি মামলার কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ দেন। একই আদালত নাবালক আসামী রাকিবুর রহমানের দায়েরকৃত ক্রিমিনাল মিস কেসের শুনানী শেষে ২৩ আগষ্ট টিআর-১৫১/১৫ মামলার চার সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেন।

রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু জানান, এসটিসি ২০৭/১৫, ২০৮/১৫ এ দু’টি মামলায় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতে বাদি মোসলেমউদ্দিন ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই এ আদালতে সাক্ষী দিতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সাক্ষী চলাকালিন আসামী পক্ষের আইনজীবী জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. আব্দুল মজিদ (২) বাদিকে চাপ সৃষ্টি করেছেন এমন অভিযোগে মোসলেমউদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এমন অভিযোগে জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমাণ্ডার সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি মোস্তফাজামান ইসলাম ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত বে আসামীপক্ষের স্থগিতাদেশ ও আপিল খারিজ করে দেন। সম্প্রতি ওই নথি সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে পৌঁছানোর পরপরই আগামি ১৬ জুন সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য করা হয়। তবে গত বছরের ৪ ফেব্র“য়ারি টিআর-১৫১/১৫ মামলায় বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে চার থেকে ১০ বছর মেয়াদে কারাদণ্ড হলেও রায় এর কয়েকদিন আগে মারা যান মামলার বাদি মুক্তিযুদ্ধচলাকালিন কমাণ্ডার মোসলেমউদ্দিন ও অন্যতম সাক্ষী জেলা আওয়ামী লীগের বারবার নির্বাচিত সভাপতি ও সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আহম্মেদ।

অস্ত্র ও বিষ্ফোরক দ্রব্য আইনের দু’টি মামলায় প্রকৌশলী শেষ মুজিবুর রহমান, ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন ও সাজিদুর রহমান চৌধুরী আগামি ১৬ জুন আদালতে সাক্ষী দেবেন বলে নিশ্চিত করেছেন জজ কোর্টের পিপি অ্যাড. আব্দুল লতিফ।

বিঃ দ্রঃ ধর্ষিতার নাম মাহফুজা খাতুন, তার স্বামীর নাম- আতিয়ার রহমান, গ্রাম- হিজলদি, উপজেলা- কলারোয়া, জেলা- সাতক্ষীরা।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)