সরকারি কেনা-কাটায় দুর্নীতি হয় কীভাবে?

বাংলাদেশের একটি হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের একটি পর্দা ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে কেনার খবরের বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
গত ২০শে অগাস্ট এ বিষয়টি ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত।
এদিকে দুর্নীতির এমন অভিযোগ ওঠার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারি কেনাকাটার বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।
এর আগে পাবনায় রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের গ্রিন সিটিতে বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয় ৬ হাজার টাকা। পরে তা গড়ায় আদালতে। এই বিষয়টি নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা ও ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য উঠেছিল।
কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় এ ধরনের অভিযোগ বারবার আসছে কেন?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘পাবলিক মানি’ বা সরকারি অর্থ নিয়ে এ ধরণের দুর্নীতি আসলে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।
কারণ এ অর্থ উন্নয়ন কিংবা জনগণের কাজে ব্যয় হওয়ার কথা থাকলেও দুর্নীতির কারণে তা ব্যক্তি পর্যায়ে কুক্ষিগত করা হয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, “এর ফলে পর্যাপ্ত অর্থ সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যয় না হওয়ার কারণে হয় সেই উন্নয়ন কাজটি বাধাগ্রস্ত হয়, না হলে নিম্নমানের কাজ করা হয় অথবা যে কাজে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার কথা ছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় হয়”।
এ ধরণের দুর্নীতি থাকলে তার দায়ভার আসলে জনগণের উপরে গিয়েই পড়ে।
প্রথমত কর হিসেবে জনগণ অর্থ দিয়ে দেয় বলে তাদের কাছে সেই নগদ অর্থ থাকে না। ফলে সে এই অর্থ নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারে না।
আর দ্বিতীয়টি হলো, করের অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার হলে মানুষ যে সুযোগ-সুবিধা পেতো তা থেকেও বঞ্চিত হয় তারা।
এই একই কারণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হয় না বলেও মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
সরকারি কেনা-কাটায় দুর্নীতি কিভাবে হয়?
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতি ও পণ্যদ্রব্য কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি করাটা সহজ বলে প্রায়ই এ খাতে দুর্নীতির অভিযোগ আসে।
তবে এখাতে দুর্নীতি ধরাটাও সহজ বিধায় এ খাতের দুর্নীতির খবর সামনে আসলেও অন্যান্য খাতের খবর বাকি থেকে যায় বলে মন্তব্য করেছেন সরকারি সাবেক আমলারা।
এ বিষয়ে সাবেক মহা হিসাব নিরীক্ষক এবং দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, “বহু ধরণের কাজের গ্রাউন্ড আছে যার দ্বারা কেনাকাটার সময় দুর্নীতি হয়ে থাকে। এটা নতুন নয়।”
“বরং বহুদিন ধরে চলে আসছে এবং সময়ের সাথে এটি বেড়েই চলেছে।”
কেনাকাটার ক্ষেত্রে দুর্নীতির এ খবর সরকার জানে বলেও মনে করেন তিনি।
আর এ কারণেই এ খাতে দুর্নীতি বন্ধে সরকার পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট এবং ই-টেন্ডারিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এ ধরণের ব্যবস্থা নিয়েও কোন লাভ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন হাফিজ উদ্দিন খান।
তিনি বলেন, “শত রকমের উপায় আছে কেনাকাটার ক্ষেত্রে দুর্নীতি করার। টেন্ডারিং প্রসেসের মধ্যে কাউকে টেন্ডার পাইয়ে দিতে চাইলে তাকে সব থেকে কম খরচের দেখানো, আগে থেকেই টেন্ডারের তথ্য ফাঁস করে দেয়া, দামের রেট বা হার বলে দেয়া, এগুলো তো আছেই।”
“এছাড়া টেন্ডারের বৈশিষ্ট্য বা শর্ত এমনভাবে সাজানো হয় যাতে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিই ওই সুযোগটি পায়। এধরণের আরো অনেক রকমের পদ্ধতি রয়েছে।”
মি. খান বলেন, এ ধরণের দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয় যদি না কেনাকাটা প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা সৎ হয়।
দুর্নীতির কারণেই রাস্তা মেরামত করলেও তা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, সেতু নির্মাণ করলেও তা ভেঙ্গে যায়। কারণ যাদের এ সব বিষয়ে নজরদারি করার কথা তাদের কেউই এগুলো দেখে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
উদাহরণ হিসেবে মি. খান বলেন, সরকার সব সড়ক ও মহাসড়কে সেতুগুলো নিয়ে একটি তথ্য ভাণ্ডার করার ঘোষণা দিয়েছে।
“তবে প্রকৌশলীরা এটা করার সময় পাচ্ছে না। কারণ তারা আসলে এটি করার বিষয়ে আগ্রহী নন। কারণ এখানে দুর্নীতির সুযোগ কম।”
দুর্নীতি কেন বন্ধ করা যায় না?
দুর্নীতি বিষয়ে বহু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একাধিক রিপোর্ট করেছে টিআইবি এবং তার প্রকাশও করা হয়েছে বলে জানান মি. খান। এসব প্রতিবেদন প্রাথমিকভাবে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বীকার করে নিলেও পরে তা অস্বীকার করে বলে জানান তিনি।
টিআইবির ট্রাস্টি মি. খান বলেন, “প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সব কর্মকর্তা টপ-টু-বোটম সবাই দুর্নীতির সাথে জড়িত। যার কারণে এ খাতে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হয় না।”
তিনি বলেন, “যেহেতু দুর্নীতি করলে পার পাওয়া যায় আর এই ধরণের নিরাপত্তা নিয়ে অর্থাৎ দুর্নীতি করার পর ধরা পরা ও শাস্তির ভয় ব্যতিরেকে দুর্নীতি করা সম্ভব হচ্ছে বলেই দুর্নীতি হচ্ছে এবং তা বন্ধ হচ্ছে না। কারণ সবাই মিলে যোগসাজশে এই দুর্নীত করে।”
৫টি পদক্ষেপের সুপারিশ
মি. খান বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে প্রথমত এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন করতে হবে। তাদের মধ্যে দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।
দ্বিতীয়ত দুর্নীতির অভিযোগ বিশেষ বিচারিক আদালতে করারও পরামর্শ দেন তিনি। তার অভিযোগ, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতাও এক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিচার থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে বেশিরভাগ সময়েই দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তার সাজা কার্যকরের উদাহরণ চোখে পড়ে না।” দুর্নীতি বন্ধে কঠোর সাজা কার্যকর করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি।
তৃতীয়ত, সংসদের একটি দায়িত্ব আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে ‘ওয়াচ ডগ’ হিসেবে ভূমিকা পালন করা। যা জাতীয় সংসদ করে না।
চতুর্থত, সাংবিধানিক কমিটির মধ্যে অন্যতম পাবলিক আকাউন্টস কমিটি। এই কমিটি থেকে যে প্রতিবেদন দেয়া হয় এবং সুপারিশ দেয়া হয় তা মন্ত্রণালয়গুলো ঠিকমতো পালন করে না।
পঞ্চমত, মহাহিসাব নিরীক্ষকের দপ্তরে অনেক ঘাটতি আছে, তাকে সেগুলো খেয়াল রাখতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
দুর্নীতি আগের চেয়ে কমেছে-দুদক
দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, দুর্নীতিকারীরা দুর্নীতি করতে ভয় পায় না বলেই আসলে দুর্নীতি ঠেকানো সম্ভব হয় না।
মি. বখত বলেন, “আইন যারা মানে, যারা ভয় পায় তারা পরবর্তীতে কোন অপরাধ করবে না। কিন্তু যারা মনে করে যে তারা আইনের শাসনের ঊর্ধ্বে তারা আইন ভয় করে না, তারা অপরাধ করে, আবার ধরা পড়ে।”
তবে দুর্নীতিকে ঠেকানো যাচ্ছে না এমনটা বিশ্বাস করতে চান না তিনি। তার দাবি, “আগের চেয়ে দেশে দুর্নীতির পরিমাণ কমেছে।”
তিনি বলেন, “কোন একটি দেশে কি একদিনেই দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে? পর্যায়ক্রমে হয়তো হবে।”
“যেসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর তদন্ত করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে হয়তো কমছে। তুলনা করলে দেখা যাবে যে, আগে যে দুর্নীতি ছিলো তা এখন কমবে।”

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)