মেট্রোরেল প্রকল্পে শুধু সম্মানিতেই ব্যয় সাড়ে নয় কোটি

রাজধানী বাড্ডার একটি বহুতল ভবনের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন ৬০ বছরের বেশি বয়সী মো. ফারুক আলম। প্রতিদিন টানা ১২ ঘণ্টা কাজ করেন। বিনিময়ে পান মাসে সাড়ে আট হাজার টাকা। সাপ্তাহিক ছুটিও কাটান না তিনি, কাটালে সেই অনুপাতে বেতন থেকে কেটে নেয়া হয় টাকা।

পটুয়াখালীতে থাকা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় ফারুক আলম তার বেতনের একটা অংশ ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) হিসেবে সরকারকে দেন। এমন নানা প্রয়োজনে ফারুক আলমের মতো কোটি দেশবাসী সরকারকে ভ্যাট দিচ্ছেন। সেই ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায় দেশে হচ্ছে হাজার কোটি টাকায় নানা উন্নয়ন প্রকল্প। তার একটি মেট্রোরেল প্রকল্প।

‘ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এমআরটি লাইন- ৬)’ নামের প্রকল্পটি ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চলতি বছরের মে মাসে এ প্রকল্পের ওপর একটি নিবিড় পরীবিক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।

আইএমইডির ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ প্রকল্পে শুধু সম্মানিতেই খরচ হচ্ছে নয় কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্পের প্রয়োজনে বিভিন্ন সভার আয়োজন করা হয়। সরকারি ও প্রকল্পে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন সভায় স্বাভাবিকভাবেই অংশ নেয়ার কথা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এরপরও এ প্রকল্পের সভায় অংশ নেয়ার জন্য কর্মকর্তাদের সাড়ে নয় কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে।

যে দেশে সাধারণ এক মানুষের আয়ের এমন পরিস্থিতি, সেই দেশে মেট্রোরেল প্রকল্পে আপ্যায়নে ব্যয় হচ্ছে ৫০ লাখ টাকা! শুধু তা-ই নয়, এ প্রকল্পে স্টেশনারি, সাপ্লাইজ ও আনুষঙ্গিক খরচ দেড় কোটি টাকা। মুদ্রণ ও প্রকাশনা ব্যয় এক কোটি, বই ও জার্নালে ১০ লাখ এবং বিজ্ঞাপন ও প্রচারে খরচ করা হচ্ছে এক কোটি টাকা।

এছাড়া প্রশিক্ষণে এক কোটি এবং সেমিনার/কনফারেন্স/ওয়ার্কশপে খরচ করা হচ্ছে এক কোটি টাকা।

এ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ খরচ হচ্ছে ৭২ কোটি ৭১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। মেট্রোরেল প্রকল্পে অফিস ভাড়ায় খরচ হচ্ছে ১০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। সেই সঙ্গে অফিস সরঞ্জাম কিনতে খরচ হচ্ছে ৫৮ লাখ ২৯ হাজার টাকা।

৫৮ লাখের বেশি খরচ হলেও আসবাবপত্র ও কম্পিউটার-সামগ্রী অফিস সরঞ্জামের বাইরে রাখা হয়েছে। আসবাবপত্র কিনতে খরচ হচ্ছে ৪২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। কম্পিউটার এক্সেসরিজে ১২ লাখ, কম্পিউটার ও এক্সেসরিজে ৪৪ লাখ ৯৫ হাজার, কম্পিউটার সফটওয়্যারে ১০ লাখ এবং কম্পিউটার ও ইকুইপমেন্ট রক্ষণাবেক্ষণে ১৪ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে।
চার হাজার ৬৫০ বর্গমিটারের অফিসে এক লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এরপরও অফিস রক্ষণাবেক্ষণে খরচ করা হচ্ছে ৫০ লাখ টাকা।

এ প্রকল্পে ১৪টি জিপ কিনতে নয় কোটি ৭৪ লাখ দুই হাজার এবং সাতটি পিক-আপ/মাইক্রোবাস কিনতে তিন কোটি ছয় লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে। এছাড়া যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণে এক কোটি ৫১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।

এসব যানবাহনের জন্য সিএনজি/গ্যাস এবং পেট্রল ও লুব্রিকেন্টে (জ্বালানি) খরচ হচ্ছে পাঁচ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। এর মধ্যে সিএনজি/গ্যাসে ৯২ লাখ ১৬ হাজার এবং পেট্রল ও লুব্রিকেন্টে চার কোটি ৫৫ লাখ ৪ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।

‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ’ – এমনই আরেকটি বড় প্রকল্প সরকারের। সেখানে দুর্নীতির চিত্রউঠে এসেছে। আইএমইডি বলছে, রূপপুর প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনায় ত্রুটিপূর্ণ ছিল।

মেট্রোরেল প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে ডিএমআরটিডিপির প্রকল্প পরিচালক মো. আফতাবউদ্দিন তালুকদারকে একাধিকবার ফোন দেয়া হয়। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি।

প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড। বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাবেক সচিব এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে তো আপনার সঙ্গে কথা বলার দরকার নাই। এটা নিয়ে আমরা ব্র্যান্ডিং সেমিনার করেছি। সেখান থেকে আপনি সব তথ্য পেয়ে যাবেন।’

আইএমইডি সম্প্রতি মেট্রোরেলের ওপর দেয়া প্রতিবেদনে ব্যয়ের হিসাব নিয়ে কথা বলতে চাইলে এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘আইএমইডির প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে আসেনি। যেহেতু আমি প্রতিবেদন দেখিনি, কাজেই আমি কথা বলব না।’

কোন খাতে কত খরচ
উপরে উল্লিখিত খাতগুলো ছাড়াও মেট্রোরেল প্রকল্পে আরও অনেক খাতে অর্থ খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে ডাক মাশুল, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ এবং টেলেক্স/ফ্যাক্স/ইন্টারনেট খরচে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দুই কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।

এর মধ্যে ডাক মাশুলে ১১ লাখ ৫২ হাজার, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগে এক কোটি দুই লাখ ২৪ হাজার, টেলেক্স/ফ্যাক্স/ইন্টারনেটে ৯৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা খরচ করা হচ্ছে। এর বাইরে টেলিফোন ইকুইপমেন্টে খরচ হচ্ছে ৯৩ হাজার টাকা।

এ প্রকল্পে শুধু পরামর্শ সেবায়ই খরচ হচ্ছে এক হাজার ২০৩ কোটি ৬৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে সাধারণ পরামর্শ সেবায় এক হাজার ১৬৩ কোটি ৭০ লাখ ৫২ হাজার, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের পরামর্শক সেবায় ২৬ কোটি ৭৯ লাখ ৭০ হাজার, পুনর্বাসন সহায়তায় ১০ কোটি ৬৬ লাখ ১৪ হাজার, টেকনিক্যাল কনসালটেন্টে দুই কোটি এবং নিরীক্ষার জন্য পরামর্শক সেবায় ৪৮ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে।

বৈদেশিক ঋণের সুদ ছয় কোটি ৫৫ লাখ ৭৫ হাজার, ব্যাংক চার্জ ও এলসি কমিশন তিন কোটি এবং আইনের জন্য খরচ বরাদ্দ ১৯ কোটি ৬৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।

ভূমি অধিগ্রহণে ৬০০ কোটি এবং রি-সেটেলমেন্টে (পুনর্বাসনে) ৫৪ কোটি ১০ লাখ ৬৭ হাজার টাকা খরচের জন্য বরাদ্দ রয়েছে।

রোলিং স্টকস ও ইকুইপমেন্টে খরচ করা হচ্ছে দুই হাজার ৮৭০ কোটি ৩৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।

সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে সিভিল ও মেইন লাইনে স্টেশন নির্মাণে। এর মধ্যে সিভিল ও মেইন লাইন স্টেশন নির্মাণে (সিপি-০৩ ও ০৪) চার হাজার ২৩০ কোটি ৫৫ লাখ ১৯ হাজার, সিভিল ও মেইন লাইনে স্টেশন নির্মাণে (সিপি-০৫) দুই হাজার ৫৪৯ কোটি ১১ লাখ ২০ হাজার, মেইন লাইন স্টেশন নির্মাণে (সিপি-০৬) এক হাজার ৫৯৫ কোটি ৫৬ লাখ ৯৯ হাজার, মেইন লাইন স্টেশন নির্মাণে (সিপি-০১) ৫৮০ কোটি ৬০ লাখ ৭৪ হাজার, মেইন লাইনে স্টেশন নির্মাণে (সিপি-০২) এক হাজার ৫৯৫ কোটি ৫৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।

ইএন্ডএম সিস্টেমে (সিপি-০৭) তিন হাজার ৭৪ কোটি ২৪ লাখ ২৩ হাজার, সিডি/ড্রাটে এক হাজার ৪৫২ কোটি ৮৫ লাখ ৪৯ হাজার, ইউটিলিটি স্থানান্তরে ৭৭১ কোটি, ফিজিক্যালি কন্টিনজেন্সিতে ৪২৩ কোটি আট লাখ ১২ হাজার এবং প্রাইস কন্টিনজেন্সিতে খরচ হচ্ছে ৪০৭ কোটি ৯২ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।

এসবের বাইরেও অন্যান্য খাতে খরচের জন্য এক কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

অগ্রগতি পিছিয়ে

ডিটিসিএ ২০০৯ সালে দুই ধাপে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডি (ডিএইচইউটিএস) শিরোনামে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। ডিএইচইউটিএসের আওতায় এমআরটি লাইন- ৬ (উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত) এবং এমআরটি লাইন- ৩ কে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়।

ডিএইচইউটিএস- ২ এর আওতায় ২০১১ সালে লাইন-৬ এর ওপর ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে ডিএমআরটিডিপি প্রকল্পে এমআরটি লাইন-৬ এর ডিপিপি ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর একনেকে অনুমোদিত হয়। এরপর ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই বরাদ্দ ঠিক রেখে প্রকল্পের আন্তঃখাত সমন্বয় করতে ডিপিপি সংশোধন করা হয়।

মূল ও সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী, ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি সাত লাখ ২১ হাজার টাকা খরচ হবে এ প্রকল্পে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি ৪৮ লাখ এবং জাইকা দেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ ২১ হাজার টাকা। ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে।

আইএমইডির নিবীড় পরীবিক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক আর্থিক অগ্রগতি ২৮ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি প্রায় ৩২ শতাংশ। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিডিপি) লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ পিছিয়ে আছে।

এ সময়ে মোট অগ্রগতি ২৮ দশমিক ৯০ শতাংশ, টাকায় যার পরিমাণ ছয় হাজার ৩৫২ কোটি ২৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ছিল পাঁচ হাজার ৬৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, যা মোট প্রকল্পের ২৩ দশমিক ০৪ শতাংশ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা দুই হাজার ৪৮৮ কোটি ৮৩ লাখ নির্ধারিত ছিল, যার শতকরা হার ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। তবে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত নয় মাসে বাস্তবায়ন হার টাকার অঙ্কে এক হাজার ২৮৭ কোটি ২৬ লাখ ৪১ হাজার। শতকরা এ হার ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)