সাতক্ষীরার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার

আমাদের স্কুলে স্থায়ী শহীদ মিনার নেই। আমরা কাঠ আর কাপড় দিয়ে প্রতিবছর অস্থায়ী শহীদ মিনার বানিয়ে মহান ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। আমরা এলাকার কমপক্ষে সাতটি গ্রাম ঘুরে প্রভাত ফেরির গান গাই। শহীদ মিনার তৈরি করে নিজেরাই ফুল সংগ্রহ করি। মালা গাঁথি, ফুলের তোড়া বানাই। সেই ফুলের মালা ও তোড়া নিয়ে একুশের প্রভাতে স্কুলে গিয়ে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। এভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন ও প্রভাত ফেরির মধ্য দিয়ে পালন করি মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেই সেই অবিনাশী গানের সুর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি…’ গর্বের সাথে বলি ‘মোদের গরব মোদের আশা, আমরই বাংলাভাষা…’। এভাবেই মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস পালনের অনুভূতি ব্যক্ত করছিলেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর ডি. বি. মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া সুলতানা, হালিমা খাতুন, জাকিয়া সুলতানা, চৈতি দেবনাথ, ফারজানা সুলতানা মিথিলা, সুমাইয়া পারভীন, খাদিজা খাতুন, মিতালী ঘোষ, কণিকা ম-ল, খাদিজা সুলতানা, তমালিকা সরদার, রাবেয়া সুলতানা, জান্নাতুল ফেরদৌস মিমসহ অনেকেই। তারা আরও জানায়, স্কুলের শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনে তাদের সহযোগিতা করে। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. এমাদুল ইসলাম বলেন, ১৯৯৫ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে মহান ভাষা দিবস উপলক্ষে অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরী করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

এ অবস্থা শুধু ডি. বি. মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে নয়, ভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছর পার হলেও জেলার প্রায় ৫৮ ভাগ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নেই শহীদ মিনার। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস পালনের জন্য কখনো অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে আবার কখনো দিবসটিতে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখে। ফলে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে শহীদ দিবসে মহান ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা থেকে।

জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলায় প্রাথমিক পরবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে মোট ৫৭৫টি। যার মধ্যে ৩৩৩টি প্রতিষ্ঠানেই নেই শহীদ মিনার। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ১২৬ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৮০টিতেই শহীদ মিনার নেই। একইভাবে দেবহাটার ৩০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১৪টিতে, আশাশুনির ৮০ প্রতিষ্ঠানের ৩২টিতে, কালিগঞ্জের ৬৯ প্রতিষ্ঠানের ৩৬টিতে, শ্যামনগরের ৮৬ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬১টিতে, তালার ৯২ প্রতিষ্ঠানের ৩০টিতে এবং কলারোয়ার ৯২ প্রতিষ্ঠানের ৮০টিতেই নেই শহীদ মিনার। এ পরিসংখ্যানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা আরও নাজুক। সদর উপজেলার ২০১টি বিদ্যালয়ের মধ্যে শহীদ মিনার আছে মাত্র ১৩টি স্কুলে। এসব প্রতিষ্ঠানের কয়েকটির শহীদ মিনারের অবস্থা আবার খুব ভালো না। এই তালিকায় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের শহীদ মিনার সবার আগে। সাতক্ষীরার অন্যতম বৃহৎ এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শহীদ মিনারের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। ভাঙন ধরেছে বেদিতেও। এর ওপর জুতা পায়ে অবাধ চলাচল করে স্থানীয় অনেকেই। মাঝে মাঝে এখানে আস্তানা গাড়ে বেদেরা। তারা জুতা পায়ে এ শহীদ মিনারের ওপর অবাধ বিচরণ করে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ আবু সাঈদ বলেন, কিছুদিন হলো শহীদ মিনারটির কিছু অংশ ভেঙে গেছে। আমরা নতুন অ্যাকাডেমিক ভবনের সামনেই নতুন শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি, যার কাজ খুব শীঘ্রই শুরু হবে। এজন্য ঐ শহীদ মিনারটি আর সংস্কার করা হয়নি। এদিকে শহীদ মিনার সম্পর্কে লাবসা ইমাদুল হক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ অহমেদ রাজ জানায়, আমাদের স্কুলে কোনো শহীদ মিনার নেই তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি না। তবে স্কুলে শহীদ দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

সাতক্ষীরা নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের আহবায়ক অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, শহীদ মিনার আমাদের চেতনার প্রতীক। শহীদ মিনারের বেদিতে বসেই আমরা প্রকাশ করি অনুভূতি। ন্যায় সঙ্গত সকল আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার শহীদ মিনার। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছর আর দেশ স্বাধীনের ৪৮ বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু দেশের শতভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনও শহীদ মিনার নির্মিত হয়নি। ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃতিফলকসহ শহীদ মিনার করা দরকার। কারণ ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি প্রথম প্রতিবাদ গড়ে তোলে। তাই বাঙালি জাতীর গৌরবময় এ অধ্যায় শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে এবং দিবসটি যথাযথভাবে পালন করার জন্য দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা প্রয়োজন।’তিনি আরও বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি অনেক স্কুল কলেজ ছুটি থাকে। এ দিন স্কুল কলেজ ছুটি না দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে দিবসটি পালন করলে শিক্ষার্থীরা শহীদ দিবস সম্পর্কে বেশি বেশি জানতে পারবে।

জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, জায়গা সংকটের কারণে কিছু কিছু স্কুলে শহীদ মিনার নির্মাণ করা কঠিন হয়ে যায়। তবে আমরাও চাই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্রুত শহীদ মিনার নির্মাণ করা হোক। যাতে স্কুল পর্যায় থেকেই সকল শিক্ষার্থীরা মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারে। শহীদ মিনার ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ প্রজন্মের কাছে ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)