সাতক্ষীরায় পরিবেশ বান্ধব চিংড়ি চাষ না হলে দরিদ্রতা বাড়বে
দেশে মোট রপ্তানিজাত চিংড়ির ৬০ শতাংশ উৎপাদন হয় সাতক্ষীরা জেলায়। দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় মূলত চিংড়ি চাষ করা হয়ে থাকে। সাতক্ষীরা ছাড়া অন্য চার জেলা হচ্ছে খুলনা, বাগেরহাট, নড়াইল ও যশোর। চিংড়ি রপ্তানি করে সাতক্ষীরা জেলা থেকে বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।
কিন্ত চিংড়ি চাষের কারণে সাতক্ষীরা জেলাতে কৃষকের দরিদ্রতা বাড়ছে। হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমিতে লোনা পানি উঠিয়ে চিংড়ি চাষ করার ফলে একদিকে যেমন কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে তেমনি কৃষি কাজে নির্ভর এমন বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট হচ্ছে। বিকল্প কর্মসংস্থানের সন্ধানে এ জেলা থেকে হাজার হাজার প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক অন্যত্র চলে যাচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী গত এক দশকের ব্যবধানে ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর ফসলী জমি চলে গেছে চিংড়ি ঘেরে । সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির হিসাব অনুযায়ী ১০ থেকে ১২ বছর আগেও সাতক্ষীরাতে কৃষি বা আবাদী জমির পরিমাণ ছিলো ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬২৬ হেক্টর। কিন্ত ক্রমান্বয়ে কমে বর্তমান কৃষি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ১২৬ হেক্টর। ফলে চিংড়ি ঘেরে চলে গেছে ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর আবাদী জমি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষি কাজ না থাকায় সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ১৫ থেকে ১৬ কৃষক বা কৃষি শ্রমিক কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।
পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এডভোকেট এস.এম আতাউর রহমান বলেন, তার ইউনিয়নের কমপক্ষে ৮ থেকে ৯ হাজার কৃষি শ্রমিক কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে গেছে। তিনি বলেন, এক সময় তার ইউনিয়নের মাঠ বা বিলে প্রচুর পরিমাণ ধান উৎপাদন হতো। কিন্ত বর্তমানে সেই সমস্ত বিলে এখন লোনা পানির চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। ফলে কৃষি কাজে নির্ভরশীল মানুষজনের কর্মসংস্থান হারিয়ে গেছে। এসব কৃষকরা বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে বেচে নিয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকার ইটভাটা বা রিকসা ভ্যান। আবার অনেকে বৈধ পাসপোর্টে ভারতে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করছে।
গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাকসুদুল আলম বলেন, চিংড়ি ঘেরের কারণে দরিদ্র কৃষকরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে তার ইউনিয়নে। ফসল না হওয়ায় এসব কৃষক কর্মসংস্থান হারিয়ে কাজের সন্ধ্যা ছুটছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তার ইউনিয়নের ৬/৭ হাজার কৃষি শ্রমিক কাজের সন্ধানে চলে গেছে।
সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মিরগাং গ্রামের প্রান্তিক কৃষক ভুপেন সরদার বলেন, তার ১০ বিঘা পরিমাণ কৃষি জমিতে ধানসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল উৎপাদন করে সংসার নির্বাহ করে আসতো। কিন্ত গত কয়েক বছর আগে সাতক্ষীরার এক প্রভাবশালী ঘের ব্যবসায়ী তার ওই জমিতে জোর করে লোনা পানি উঠিয়ে দেয়। একপর্যায়ে তার ওই জমিতে চিংড়ি চাষে বাধ্য করা হয়। এই কৃষক আরো বলেন, জমিতে ফসল উৎপাদন করে যে ভাবে সংসার সচ্ছল ছিলো। কিন্ত চিংড়ি ঘের করে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া চিংড়ি চাষ তার কাছে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ । এখন না পারছে ফসল ফলাতে না পারছে ঘের ছাড়তে। ফলে সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এই কৃষক।
জাতীয় কৃষকজোট কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ আশেক-ইলাহী জানান, উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্ত পরিবেশ বিধ্বংসী চিংড়ি চাষের কারণে কৃষকের দরিদ্রতা বেড়ে চলেছে। যে সমস্ত জমিতে কৃষক ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করতো সেখানে লোনা পানি তুলে চাষ করা হচ্ছে চিংড়ি। ফলে কমে যাচ্ছে কৃষি কাজ। বিকল্প কর্মসংস্থানের সন্ধানে এ জেলা থেকে হাজার প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক অন্যত্র চলে যাচ্ছে। তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইটভাটা ও অন্যান্য কাজে নিয়জিত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সরকার চিংড়ি চাষকে নিয়ন্ত্রণ করে কৃষি নীতিমালাকে আরো যুগোপযোগী করে না তুললে আগামীতে এ জেলার কৃষক আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মো, নুরুল ইসলাম জানান, সাতক্ষীরা জেলাতে কৃষি বা আবাদী জমি রক্ষা করার জন্য সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী‘র দপ্তর থেকে একটি পত্র এসেছে। দীর্ঘদিন যাবত এখানকার কৃষি জমিতে লোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। ফলে বিপুল পরিমাণ আবাদী জমি চলে গেছে চিংড়ি ঘেরের মধ্যে। বিশেষ করে অপরিকল্পিত ভাবে চিংড়ি চাষ করায় এ জেলার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্মক ভাবে। হাজার হাজার কৃষি শ্রমিক কর্মসংস্থান হারাচ্ছে।