বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অংশগ্রহণ (পর্ব- ১)

একটা কথা বলা হয় যে বাঙ্গালীদের প্রেম ছিল আসলে ফুটবলের সাথে, বিয়ে হয়ে গেছে ক্রিকেটের সাথে। চার বছর পরপর বিশ্বকাপ আসলে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মত লাতিন শক্তি কিংবা জার্মানি, পর্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স বা বেলজিয়ামের মত ইউরোপীয় দলগুলোর সমর্থনে এদেশে যে হুলুস্থুল কান্ড বাধে তা নিজের দেশ ক্রিকেট বিশ্বকাপে গেলেও সেভাবে বাধে না।

‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’ নামে গান তো বিখ্যাত হয়ে আছে। এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের যথেষ্ট অবদান ছিল। নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও ফুটবলই ছিল এদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু আজ দেশের মৃতপ্রায় ফুটবল দেখে অভ্যস্ত নতুন প্রজন্ম জানে না আসলে বিশ্বকাপে কোনোদিনও সুযোগ না পাওয়া বাংলাদেশ আসলে ঠিক বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার ঠিক কতটুকু কাছাকাছি যেতে পেরেছিল।

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হলেও ১৯৭৪, ১৯৭৮ কিংবা ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অংশ নেয়নি। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে প্রথম অংশ নেয় সেই ম্যারাডোনার স্মৃতিবিজড়িত ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে। বাংলাদেশ কনফেডারেশন হিসেবে এএফসি (এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন) এর অন্তর্ভুক্ত।

১৯৮৬ সালের বাছাইপর্বে এশিয়ান কনফেডারেশন থেকে ২৭ টি দল অংশ নিয়েছিল যার মধ্যে মাত্র দুইটি দল বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছিল। উল্লেখ্য, সেই বিশ্বকাপে মোট ২৪ টি দল অংশ নিয়েছিল। এশিয়া থেকে সুযোগ পাওয়া দল দুটি ছিল ইরাক এবং দক্ষিণ কোরিয়া।

বাংলাদেশ সেবারই প্রথম বাছাইপর্বে অংশ নেয় এবং বাছাইপর্বের প্রথম পর্বেই বিদায় নেয়। এরপরেও ৬ টি ম্যাচে অংশ নিয়ে ঠিকই দুটি জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ।

এই বাছাইপর্বের ফরম্যাট ছিল এমন যে – পুরো এশিয়া মহাদেশকে ইস্ট এশিয়া ও ওয়েস্ট এশিয়া নামে দুটি জোনে ভাগ করে তিন বা চারটি করে দল একেকটি গ্রুপে নিয়ে প্রতিটি জোনে চারটি করে গ্রুপ করা হয়। প্রতিটি গ্রুপ থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়নরা পরবর্তী রাউন্ডে যায়। এরপর সেমিফাইনাল ও ফাইনাল ম্যাচের মাধ্যমে প্রতিটি জোন থেকে একটি করে দল বিশ্বকাপে সুযোগ পায়।

এর মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ইস্ট এশিয়া জোনের 3B গ্রুপে। বাংলাদেশের গ্রুপ সঙ্গী ছিল ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও থাইল্যান্ড। চার দলের গ্রুপে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের পয়েন্ট সমান হলেও গোল পার্থক্যে বাংলাদেশ চতুর্থ হয়। প্রত্যেক দল হোম অ্যাওয়ে ভিত্তিতে পরস্পরের সাথে দুটি করে ম্যাচ খেলে।

বাংলাদেশ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ইতিহাসে তাদের প্রথম ম্যাচ খেলে ১৯৮৫ সালের ১৮ মার্চ ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে জাকার্তায়। বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্রথম ম্যাচে খেলতে নেমে ইতিহাস গড়েন ১১ জন ফুটবলার। কোচ ছিলেন আব্দুল রহিম। আর প্রথম একাদশে ছিলেন গোলরক্ষক মোহাম্মদ মহসিন এবং বাকি ১০ জন ছিলেন নাজির আহমেদ অলক, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, আব্দুল বাতেন, আলি আজমত, আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, খন্দকার ওয়াসিম ইকবাল, ইলিয়াস হোসেন, আশীষ ভদ্র, খুরশীদ আলম বাবুল ও কায়সার হামিদ। যদিও ম্যাচটিতে বাংলাদেশ ২ – ০ গোলে হেরে যায়। প্রথমার্ধ গোলশূন্য শেষ হলেও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই দুই গোল হজম করে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ তাদের দ্বিতীয় ম্যাচটি খেলতে নামে ২৩ মার্চ থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাংককে। এই ম্যাচে একাদশে দুটি পরিবর্তন ছিল। আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু এবং কায়সার হামিদের বদলে দলে ছিলেন সালাম মুর্শেদী এবং কাজী জসীমউদ্দিন। এই ম্যাচেও তেমন কিছুই করতে পারেনি বাংলাদেশ। ম্যাচটি ৩ – ০ গোলে হেরে যায় তারা।

বাংলাদেশ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে এসে দেশের মাঠে প্রথম খেলতে নামে। ১৯৮৫ সালের ৩০ মার্চ ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে (মতান্তরে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে) অনুষ্ঠিত হওয়া এই ম্যাচে বাংলাদেশ খেলতে নামে ভারতের বিপক্ষে। ম্যাচে আবারও দুটি পরিবর্তন হয়। দ্বিতীয় ম্যাচে দলে আসা সালাম মুর্শেদী এবং কাজী জসীমউদ্দিন বাদ পড়েন।

আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু দলে ফেরেন। নতুন করে দলে আসেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম। ভারতের দলটিতে ১১ জনের মধ্যে ৮ জনই ছিলেন বাঙালি ফুটবলার। এই ম্যাচে এসে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে প্রথম গোলের দেখা পায়। ৩৪ মিনিটের মাথায় শিশির ঘোষের গোলে ভারত এগিয়ে গেলেও ৪২ মিনিটের মাথায় গোলটি শোধ করে আজীবন ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম খোদাই করে নেন আগের ম্যাচে দলে না থাকা আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু। ম্যাচের শেষদিকে ৮৪ মিনিটে বিকাশ পাঁজি গোল করে ভারতকে জিতিয়ে দেন।

এর পরের ম্যাচে এসে বাংলাদেশ দেখা পায় প্রথম জয়ের। ২ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া এই ম্যাচে বাংলাদেশ ২ – ১ গোলে হারিয়ে দেয় পরবর্তীতে এই গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়া ইন্দোনেশিয়াকে। ওই বাছাইপর্বে এটিই ছিল ইন্দোনেশিয়ার হেরে যাওয়া একমাত্র ম্যাচ। এই ম্যাচে আগের ম্যাচের দল থেকে বাদ পড়েন আব্দুল বাতেন, মোহাম্মদ আসলাম ও খুরশিদ আলম বুলবুল। দলে ফেরেন সালাম মুর্শেদী এবং কায়সার হামিদ এবং দলে যোগ হন স্বপন কুমার দাস। ম্যাচের ১১ মিনিটে গোল করে ইন্দোনেশিয়া এগিয়ে গেলেও ৭৫ মিনিটে কায়সার হামিদ এবং ৮১ মিনিটে আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু গোল করে দলকে এনে দেন বাছাইপর্বের ইতিহাসে প্রথম জয়।

পরবর্তী ম্যাচও দেশের মাঠেই খেলে বাংলাদেশ। ৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়া এই ম্যাচে বাংলাদেশ ১ – ০ গোলে থাইল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়। এই ম্যাচে সালাম মুর্শেদীর বদলে দলে আসেন বাদল রায়। ৭৬ মিনিটে দেয়া ইলিয়াস হোসেনের একমাত্র গোলে বাংলাদেশ জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে।

বাংলাদেশ এই বাছাইপর্বের সর্বশেষ ম্যাচ খেলে ১২ এপ্রিল ১৯৮৫ সালে ভারতের বিপক্ষে কোলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়াম বা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। আগের ম্যাচের অপরিবর্তিত একাদশ নিয়েই বাংলাদেশ মাঠে নামে। ভারতের এদিনের দলেও ছিলেন ৮ জন বাঙালি। ম্যাচের ১৫ মিনিটে আশীষ ভদ্রের গোলে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও ৩৬ মিনিটে বিকাশ পাঁজি ও ৫৪ মিনিটে ক্যামিলো গনজালভেস এর গোলে ভারত ম্যাচে জয় পায়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)