এলপিজিতে উৎসাহ থাকলেও স্বস্তি নেই

দেশে আবাসিক ও পরিবহন খাতে পাইপলাইনের গ্যাসের পরিবর্তে এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) ব্যবহারে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারণী অংশ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এমন বক্তব্য প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপে এর প্রতিফলন নেই। আন্তর্জাতিক মূল্যের চেয়ে বেশি দামে নিত্য ব্যবহৃত এই পণ্য কিনতে হচ্ছে গ্রাহকদের। মাঠপর্যায়ে বেচাকেনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণে জনগণ একদিকে অতিরিক্ত দামে পণ্যটি কিনতে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে অনিরাপদ পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনার আশঙ্কার মধ্যে জীবন পার করছে।

বেশি দাম বাংলাদেশে : বিভিন্ন দেশের পেট্রোলিয়াম সংস্থার ওয়েবসাইট ও সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, উৎপাদন ও আমদানি-রপ্তানির খরচের পার্থক্যের কারণে দেশভেদে এলপিজির দামও ভিন্ন হয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্বে এলপিজির দাম সবচেয়ে কম আলজেরিয়ায়; প্রতি কেজি সাড়ে ১৩ টাকা (শূন্য দশমিক ১৬ মার্কিন ডলার)। সবচেয়ে বেশি দাম সুইডেনে, ১৮৫ টাকা (২ দশমিক ১৯ ডলার)। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ভর্তুকিসহ ও ভর্তুকিহীন—দুভাবেই এলপিজি বিক্রি হয়। দেশটিতে প্রতি ১৪ দশমিক ২ কেজির ভর্তুকিহীন সিলিন্ডারের দাম ৭৮৫ টাকা (৬৩৭ রুপি) আর ভর্তুকিযুক্ত সিলিন্ডারের দাম ৬১৪ টাকা (৪৯৮ রুপি)। এই হিসাবে ভারতে প্রতি কেজি এলপিজির দাম ৫৫ টাকা ২৮ পয়সা।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ১২ কেজি ওজনের সিলিন্ডার। এর বাইরে ৫, সাড়ে ১২, ১৮, ২৪, ৩২ ও ৩৬ কেজি এলপিজি-ভর্তি বোতল বা সিলিন্ডার পাওয়া যায়। এলপিজি অপারেটরদের দাবি, প্রতি ১২ কেজি সিলিন্ডারের গড় খুচরা দাম ১ হাজার টাকা। অর্থাত্ প্রতি কেজি এলপিজির দাম ৮৩ টাকা ৩৩ পয়সা। তবে অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেন, ১২ কেজির এলপিজি এলাকাভেদে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকায়ও কিনতে হচ্ছে।

গত ১ জুলাই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভারতে এলপিজির মূল্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়। ওই মূল্যতালিকা অনুযায়ী দেশটিতে প্রতি কেজি এলপিজির মূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৫ টাকা ২৮ পয়সা। এর ওপর দেশটির নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রতি কেজি এলপিজিতে ১২ টাকা ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী ফয়জুর রহমান তার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ঢাকার বাসায় ব্যবহারের জন্য তিনি ১২ কেজির সিলিন্ডার ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০ টাকায় কেনেন। কিন্তু মাসখানেক আগে ঈদের ছুটিতে বরিশালে গ্রামের বাড়িতে ১২ কেজির সিলিন্ডার ১ হাজার ৩০০ টাকায় কিনেছিলেন তিনি। এমন অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন আরও কয়েকজন।

মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীরা : এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও খাতসংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে এলপিজি প্রয়োজন এবং কিনতে সক্ষম এমন গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী বার্ষিক ১৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি এলপিজি সরবরাহ করা দরকার। তবে আমদানি ও বিক্রি হচ্ছে বার্ষিক প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি। এর মধ্যে ২০ হাজার মেট্রিক টনেরও কম এলপিজি সরকারিভাবে বিক্রি হয়। ৭০০ টাকার এই সিলিন্ডার সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে দেখা যায় না। এগুলোর সিংহভাগ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যবহূত হয়। দুটি সরকারি এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও তা এখন পর্যন্ত আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ। প্রকৃত অগ্রগতি নেই। সব মিলিয়ে এলপি গ্যাসের বাজার পুরোটাই বেসরকারি কোম্পানিগুলোর দখলে। এই পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে সরকার ভূমিকা রাখতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. মোহাম্মদ শের আলী বলেন, এলপিজির মূল্য নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এ নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। প্রয়োজনে আরো আলোচনা করা হবে। নীতিমালাটি যত দ্রুত সম্ভব প্রণয়নে সরকার কাজ করছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জানায়, এলপিজি ব্যবসার জন্য প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে ৫৭টি কোম্পানি। এর মধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদন বা বাজারজাত করার অনুমোদন পেয়েছে সাতটি। এই সাতটিসহ চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা ২২টি কোম্পানি খুচরা বাজারে এলপি গ্যাস বিক্রি করছে। বাজারে মিলছে এমন কোম্পানি বা ব্রান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে- বসুন্ধরা, ওমেরা, বেক্সিমকো, পেট্রোম্যাক্স, টোটাল, বিএম এলপি গ্যাস, এনার্জিপ্যাকের জি গ্যাস, লাফ্স গ্যাস, ইউনিগ্যাস, ইউরোগ্যাস, ইউনিভার্সাল, ইন্ট্রাকো, যমুনা ও সেনা এলপিজি। সরেজমিন পর্যবেক্ষণ এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় দেখা যায়, কোনো কোম্পানিই সিলিন্ডারে খুচরা মূল্য উল্লেখ করে না। ফলে দোকানদাররা অধিকাংশ সময়েই গ্রাহককে বিভ্রান্ত করে বেশি দামে তা বিক্রি করে।

নৈরাজ্যের কারণে উৎসাহ হারাচ্ছে: ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় গ্রাহক পর্যায়ে আলোচনা করে দেখা যায়, এলপিজির দামে সমন্বয় না থাকায় ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারের কারণে অনেক গ্রাহকই এটি কেনার উত্সাহ পান না ও নিরাপদ মনে করেন না। চলতি মাস থেকে সরকার এক চুলা ও দুই চুলার আবাসিক গ্যাসের মাসিক বিল যথাক্রমে ৯২৫ ও ৯৭৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। এ দামের কাছাকাছি এক মাসের প্রয়োজনীয় এলপিজি কেনা গেলে পাইপলাইনের গ্যাসের ওপর নির্ভরতার দরকার হয় না। কিন্তু ফ্যাক্টরি থেকে ডিস্ট্রিবিউটর, ডিলার, সাব-ডিলার হয়ে খুচরা দোকানে এলপিজির দামে আর শৃঙ্খলা থাকে না।

এ প্রসঙ্গে বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের মহাব্যবস্থাপক (বিজনেস অপারেশনস অ্যান্ড প্ল্যানিং) প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া জালাল বলেন, ব্যবসায় শৃঙ্খলা আমরাও চাই। মূল্য নির্ধারণ নীতিমালার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যেমন নির্দেশনা আসবে আমরা তেমনই পালন করবো। তবে বিদ্যমান অবস্থায় এলপিজি অপারেটররাও লোকসান গুনছেন। কেউই লাভ করতে পারছেন না। এলপিজির মোট দামের ১২ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ দিতে হচ্ছে। এ থেকে রেয়াত মিললে দাম কমানো যেতে পারে।

বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং জ্বালানি সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বিদেশে থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)