ওয়ার্নের হ্যাটট্রিক সেঞ্চুরিতে উড়ে গেল পাকিস্তান

‘দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয় তাহলে দাগই ভালো’-অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নারের জীবনে একটি কালো দাগ বসিয়ে দিয়ে গেছে ফিক্সিং কেলেঙ্কারি। যে কেলেঙ্কারির কালো দাগ হয়তো আজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে ওয়ার্নারকে। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কালো দাগকেও নিমিষেই মিইয়ে দেয়া যায় কিছু জিনিস দিয়ে। সেটারই যেন সন্ধান পেয়ে গেলেন ওয়ার্নার। দীর্ঘ এক বছর জাতীয় দল তথা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে থাকার ফলেও এতটুকু কমেনি ওয়ার্নারের ব্যাটের ধার। পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে এসেই বুঝিয়ে দিলেন কেন তাকে সময়ের অন্যতম সেরা ওপেনার বলা হয়। অনবদ্য সেঞ্চুরি করে যখন আকাশে উড়ছিলেন ওয়ার্নার তখনই লেখা হয়ে গেছে পাকিস্তানের বিদায়। তার সেঞ্চুরিতেই যেন অস্ট্রেলিয়ার কাছে উড়ে গেল নখদর্পহীন পাকিস্তান।

পাকিস্তান চাইলেই ম্যাচটা নিজেদের করে নিতে পারতো শুরুতেই। কিন্তু অধিনায়ক সরফরাজ পেস বোলিং উপযোগী পিচে অবধারিতভাবেই বোলিং নেন। তবে তার দলের পেসাররা একদমই হতাশ করে তাকে। এমন বাজে পেস বোলিং হয়তো এর আগে তেমন একটা দেখা যায়নি পাকিস্তানের হয়ে বিশ্বকাপে। এক মোহাম্মদ আমির ছাড়া কোনো পেস বোলারই নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। আর এটিরই সুযোগ নেন অজি দুই ওপেনার।

টনটনের ছোট্ট মাঠের ফায়দা লুটে। পাকিস্তানি বোলারদের বাউন্ডারি ওভার বাউন্ডারি মারতে থাকেন ফিঞ্চ এবং ওয়ার্নার। আগের তিনটি ইনিংসে যথাক্রমে ৮৯, ৩ ও ৫৬ রান তুললেও ধীরগতিতে ব্যাটিং করার জন্য সমালোচনা পেতে হয় ওয়ার্নারকে। অথচ তার সহজাত ব্যাটিংই হল মারকুটে। দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বাইরে থাকায় এটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় নিচ্ছিলেন।

পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচেও ওয়ার্নার ছিলেন বেশ সাবধানী। দ্বিতীয় ওভারে শাহিন আফ্রিদির বলে চার মেরে নিজের চারের খাতা খুলেন ওয়ার্নার। কিন্তু তার থেকেও বেশি মারমুখী ছিলেন অধিনায়ন অ্যারন ফিঞ্চ। প্রথম দশ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে ৫৬ রান তোলে অস্ট্রেলিয়া যেখানে ফিঞ্চের ছিল ২২ রান। অথচ এরপরের দশ ওভারে ফিঞ্চ রুঢ়মূর্তি ধারণ করেন। ১৫ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার রান যখন ৯১ তখন পরের ওভার করার জন্য আসেন মোহাম্মদ হাফিজ।

হাফিজের ওই ওভারেই দুটি চার ও একটি ছক্কা হাঁকিয়ে ৬৩ বলে তুলে নেন নিজের ২৩তম অর্ধশতক। অস্ট্রেলিয়া ১৬ ওভারেই ১০৭ রানে পৌছে যায়। ২২তম ওভারে ওয়ার্নার যখন হাসান আলীকে চার মেরে ৫১ বলে নিজের হাফসেঞ্চুরি পুর্ণ করেন তখন ফিঞ্চের রান ৮২। যখন তাকে চোখ রাঙানি দিচ্ছিল এবারের বিশ্বকাপে তার প্রথম সেঞ্চুরির ঠিক তখনই আঘাত হানেন মোহাম্মদ আমির। কভারে হাফিজের কাছে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন অধিনায়ক। দলকে ১৪৬ রানে রেখে ২২তম ওভারে যখন আউট হন ফিঞ্চ এরপরে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে অজিদের রান তোলার গতি।

২৪তম ওভারে হাসান আলীকে টানা দুটি চার হাঁকান ওয়ার্নার। ২৮তম ওভারে শোয়েব মালিককে একটি ছক্কা ও একটি চার হাঁকিয়ে পৌছে যান ৮০ রানে। এর পরের ওভারেই স্মিথকে ১০ রানে ফেরান হাফিজ। এরপর শুরু হয় ম্যাক্সওয়েল ঝড়। খাজা, শন মার্শকে টপকে টু ডাউনে ম্যাক্সওয়েল ১০ বলে দ্রুত গতির ২০ রান করে শাহিন আফ্রিদির শিকারে পরিণত হন। অপরপ্রান্তে তখন ওয়ার্নার ব্যাট করছেন ৯৪ রান নিয়ে।

৩৫ তম ওভারে শাহিন আফ্রিদিকে কিপার এবং প্রথম স্লিপের মাঝে দিয়ে ভাগ্যপ্রসূত চার মেরে পেয়ে যান কাঙ্ক্ষিত সেই শতক। ওয়ার্নারের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১৫তম শতক এটি।  মজার ব্যাপার হলো পাকিস্তানের বিপক্ষে এ নিয়ে টানা তিন ওয়ানডে ম্যাচে সেঞ্চুরি করলেন ওয়ার্নার। এর আগে ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি সিডনিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে করেছিলেন ১৩০ রান, ২৬ জানুয়ারিতে এডিলেডে করেছিলেন ১৭৯ রান। এই দুই ম্যাচের পর আজকেই পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে খেললেন এবং সেঞ্চুরির হ্যাটট্রিক পূর্ণ করলেন। আরো মজার ব্যাপার হলো টেস্টেও পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ তিন ইনিংসে দুটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ওয়ার্নার।

সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে নিজের ইনিংসকে বেশি দূর নিয়ে যেতে পারেননি ওয়ার্নার। শতরানের সঙ্গে আর ৭ রান যোগ করে ১০৭ রানে শাহিন আফ্রিদির বলে ডিপ পয়েন্টে ইমামের কাছে ক্যাচ দিয়ে আউট হন ওয়ার্নার। অসাধারণ এই ইনিংসটিকে ওয়ার্নার সাজান ১১টি চার ও ১টি ছক্কায়। ওয়ার্নার যখন দলকে ৩৮ ওভারে রেখে আউট হন, তখন দলের রান ৪ উইকেট হারিয়ে ২৩৪ রান। নিশ্চিত ভাবেই অজিদের চোখে তখন সাড়ে তিনশোর বেশি করার স্বপ্ন। কিন্তু সেটা মিইয়ে যায় শেষ দিকে পাকিস্তানি পেসারদের বিধ্বংসী বোলিংয়ে।

শেষ দশ ওভারে মাত্র ৫১ রান নিতে সক্ষম হয় অস্ট্রেলিয়া। এবং এক ওভার বাকি থাকতেই তারা অল আউট হয় ৩০৭ রানে। অজিদের এই সর্বনাশটা একাই করেন মোহাম্মদ আমির। যেখানে পাকিস্তান বোলাররা বেধরক মার খেয়েছে সেখানে স্রোতের বিপরীতে আমির বোলিং করে ১০ ওভারে মাত্র ৩০ রান দিয়ে নেন ৫ উইকেট। যেটি আমিরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ উইকেট শিকার। শন মার্শ ২৩ ও এলেক্স ক্যারি করেন ২০ রান।

ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার পাওয়া ডেভিড ওয়ার্নার বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে আরো কিছুক্ষণ ক্রিজে থাকা দরকার ছিল। ৭০ বল বাকি থাকতে আমি আউট হয়েছি যেটা খুব হতাশাজনক ছিল আমার জন্য। কিন্তু আমির বেশ ভালো বোলিং করেছে। সে ভালো লাইনে বোলিং করে আমাদের পরীক্ষা নিয়েছে। বেশ সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছে আমির এবং সে এটার পুরস্কারও পেয়েছে। আমাদের ৫০ ওভার পুরো ব্যাটিং করা উচিত ছিল। ৩৪০-৩৫০ করাটা উচিত ছিল কিন্তু পাকিস্তানি বোলাররা ভালো বোলিং করেছে। তাদের সেকেন্ড বোলিং স্পেল ছিল অসাধারণ। এটি উইকেটে আগেও খেলা হয়েছে। বল কিছুটা মুভ করে এখানে। বল খুব সোজা এসেছে আমার যে কারণে আমি উইকেট ছেড়ে খেলতে পারিনি। প্রথম দিকে মুভমেন্ট ছিল কিন্তু পরে কমে সে। একজন ব্যাটসম্যানের কাছে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করাটা বিশেষ কিছু। পাকিস্তানও চেষ্টা করেছে কিন্তু আমাদের বোলাররা দারুণ বোলিং করেছে। অসাধারণ ম্যাচ ছিল এটি।

৪১ রানের এই জয়ের মাধ্যমে পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা ৯ ওয়ানডে ম্যাচ জেতার রেকর্ড গড়লো অস্ট্রেলিয়া। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের বিপক্ষে কোন ম্যাচ হারেনি তারা।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)