‘বাংলাদেশ মডেল’ চায় ভারত

ভারতের কাশ্মীর সীমান্তে বোমা হামলায় প্রায় অর্ধশত সেনা নিহত হওয়ার ঘটনার পর ভারত উপমহাদেশে একরকম বন্ধুহীন অবস্থায় আছে বলে আত্মোপলব্ধি হয়েছে দেশটির। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের আর কোন সার্কভুক্ত বন্ধু নেই। তবে ভারতের বন্ধুহীন অবস্থার জন্য তাদের চিরশত্রু পাকিস্তান নয়। বরং এর মূল কারণ চীন।

গত এক দশক ধরে সার্কভুক্ত দেশসমূহে নীরবে বিনিয়োগ করে চলেছে চীন। ভারতের পূর্বে অবস্থিত ভূটানকে একসময় ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের মতোই বিবেচনা করতো বিশ্ব। কিন্তু সেখানে এখন চীনের একাধিপাত্য স্থাপিত হয়েছে। মালদ্বীপের সর্বশেষ নির্বাচনে চীন ও ভারতের দুটি পক্ষ নির্বাচনে অংশ নেয়। সেখানে চীনের পক্ষ বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করে। দেশটিতে চীনের বিপুল বিনিয়োগ হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই নেপালে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব বিরাজ করছিল। বিশেষ করে ২০১৫ সালে ভারতের মতামত না নিয়ে নেপাল সংবিধান প্রণয়ন করলে ভারত ক্ষেপে যায়। এরপর ২০১৬ সালে ভূমিকম্পের সময় ভারত নেপালের উপর অবরোধ আরোপ করে। এরপর থেকে দেশটিতে ভারতের সমর্থন খুবই নাজুক। সেই জায়গা ধরে নিয়েছে চীন। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই খারাপ ছিল। দেশটিতে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের জন্য ভারতকেই দায়ী করে দেশটির নীতি নির্ধারকরা। এর ফলে সেখানেও নিজেদের শক্ত অবস্থান হারিয়েছে ভারত। সেখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিজেদের দিকে নিয়ে নিয়েছে চীন।

ভারতীয় উপমহাদেশে পরিকল্পিত বিনিয়োগ করছে চীন। বিভিন্ন উন্নয়ন অবকাঠামো, নির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের মাধ্যমে উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তার করছে চীন। তবে পারতঃপক্ষে তারা রাজনৈতিকভাবে কোন অবদান রাখে না।

দেখা যাচ্ছে, যে সমস্ত দেশে চীন বিপুল বিনিয়োগ করেছে তাদের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জলাঞ্জলী দিতে হয়েছে বা তাদের সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।

এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। বাংলাদেশেও চীনের বিপুল বিনিয়োগ ঘটেছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক তুঙ্গে। চীনের অর্থায়নে সিলিকন রাস্তা হচ্ছে। এরপরও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আগের মতোই অটুট রয়েছে। সিলিকন রাস্তার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সিলিকন রোড নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যারা ভারত ও চীনের সঙ্গে একইসঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ কূটনীতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষিত কূটনৈতিক কৌশল-‘সবার সঙ্গে মিত্রতা, কারোর সঙ্গে বৈরিতা নয়’ বজায় রাখার জন্য। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার জন্য ভারত ও চীনের উভয়ের কাছে আবেদন করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসায়িক দিক বিবেচনা করে তারা সে আবেদনে সাড়া না দিলেও তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটায়নি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এমন একটি কূটনৈতিক নীতি ও পরিকাঠামো তৈরি করেছে যেখানে বাংলাদেশের উপর সবাই সন্তুষ্ট। বাংলাদেশ কারোর বিশ্বাস ভঙ্গ করে না। বাংলাদেশের কূটনীতিতে তিনটি মৌলিক বিষয় এখন অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত, যা সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশের অত্যন্ত পরিস্কার, সৎ ও স্বচ্ছ ইমেজ তৈরি করেছে। এ নীতিগুলো হলো;

(১) বাংলাদেশ তার ভূ-খণ্ড কোন জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের কাজের জন্য ব্যবহার করতে দেয় না,

(২) বিশ্ব মানবতা ও মানবিক বিষয়কে বাংলাদেশ সবার উপরে প্রাধান্য দেয়,

(৩) বাংলাদেশ অর্থনৈতিক কূটনীতির সঙ্গে রাজনৈতিক কূটনীতিকে জড়িয়ে ফেলে না।

যার ফলে ভারতের সঙ্গে যেমন অনেকগুলো ব্যবসায়-বাণিজ্যের অগ্রগতি হয়েছে, তিস্তা পানি চুক্তি ছাড়া ভারতের সঙ্গে অন্যসব চুক্তি মিমাংসিত হয়েছে। তেমনিভাবে চীনের সঙ্গে দ্রুত বর্ধিষ্ণু বাণিজ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অনেক কূটনীতিক মনে করছেন, উপমহাদেশে স্থিতিশীলতা, শান্তি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ মডেল জরুরি। কারণ যেসমস্ত দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক হয়েছে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ভারত। এসব দেশে নানারকম রাজনৈতিক অস্থিরতা ও টানাপোড়েন সৃষ্টি হচ্ছে।  প্রত্যেকটা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ভারতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আবার কাশ্মীর ঘটনার পর ভারতও অনুভব করছে যে, সার্ক অঞ্চলে ভারতের মিত্রের সংখ্যা কমে গেছে। ভারতের একাধিপত্যের জায়গায় তারা এখন প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সার্কের অন্য দেশগুলোও যেন বাংলাদেশ মডেল অনুসরণ করে সে ব্যাপারে আগ্রহী ভারত। পাকিস্তানকে মোকাবিলা করার জন্য উপমহাদেশে ভারতের বন্ধু দরকার। ৭০ এর দশকে পাকিস্তানকে একঘরে করে যেমন ভারত অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিল, সেই অবস্থায় ফিরে যেতে চায়। আর তার জন্য বর্তমানে চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। চীনের সঙ্গে ভারত একটি সমঝোতা করতে চায় এবং সেখানে বাংলাদেশ মডেল অপরিহার্য হয়ে ধরা পড়েছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)