পুষ্টি ভরা হাতে ভাজা মুড়ি

মিলে মুড়ি ভাজার কারণে হাতে ভাজা মুড়ির কদর কমলেও এতে রয়েছে পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ। এমনই কথা বলেছেন সাতক্ষীরা আশাশুনি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. অরুণ কুমার ব্যানার্জী।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ফিংড়ী ইউপির গৃহিণীরা মুড়ি ভাজার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ব্যস্ততার পাশাপাশি তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে হতাশাও।

পুঁজি সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না মেশিনে ভাজা মুড়ির সঙ্গে। ফিংড়ী অঞ্চলের গোস্টনাথ, অঞ্জননাথ, সুবোল নাথ বলেন বাব-দাদার এই পেশা ছেড়ে এখন অনেকে অন্য পেশায় চলে গেলেও কিছু মানুষ ধরে রেখেছেন এ পেশাকে।

ফিংড়ী গ্রামের দেবনাথ পাড়াসহ আশপাশ এলাকার অনেক পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করেন হাতে মুড়ি ভেজে। পুরুষরা বাজারজাত করলেও মুড়ি ভাজার সব কাজ করেন নারীরাই। মিলে মুড়ি ভাজার কারণে হাতে ভাজা মুড়ির কদর কমে যাচ্ছে। তারপরও হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদার যেন শেষ নেই। এ পাড়ায় প্রতিদিন কয়েক মণ মুড়ি ভাজা হয়। মুড়ি ভাজার জন্য স্থানীয় ভাষায় চাল খোলা, বালু খোলা, চালন, ছামনি ও পাটকাটি নামক সরঞ্জাম মুড়ি ভাজার কাজে ব্যবহৃত হয়।

মাটির তৈরি পাত্রগুলো বাজারে কুমার বা পালদের কাছে পাওয়া যায়। একটি পাত্রে বালি ও একটি পাত্রে লবণ পানি মেশানো চাল রেখে চুলায় আগুনে তাপ দিতে হয়। পরিমাণ মতো তাপ শেষ হলে চাল বালির পাত্রে ঢেলে ঝাঁকুনি দিয়ে পাশের ছামনিতে বসানো তলা ছিদ্র যুক্ত পাত্র ঢেলে দেয়া হয়। তারপর চালা দিয়ে চেলে বস্তায় ভরে বাজারজাত করা হয়।

প্রতিদিন ভোর থেকেই গৃহিণীরা এই মুড়ি ভাজার কাজ শুরু করেন। অনেকে চালা (ছাকনি) দিয়ে চালিয়ে মুড়ি থেকে বালি ছাড়াচ্ছে, কেউ বস্তা ভরছেন। ব্যবসায়ীরা সাতক্ষীরা, বুধহাটা, বড়দল, বাঁকা প্রভৃতি এলাকায় চলে যাচ্ছে।

ফিংড়ী ইউপির গাভা গ্রামের ভিমদেবনাথের স্ত্রী সুচিত্রা দেবনাথ বলেন, ভোর থেকে মুড়ি ভাজার কাজ শুরু করি। এই কয় ঘণ্টায় মুড়ি ভেজে প্রতিদিন দুই-তিনশ টাকা আয় করতে পারি। এই মুড়ির টাকা দিয়েই সংসার চলে।

তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে এই হাতে ভাজার মুড়ি কাজ করি। এই হাতের ভাজা মুড়ি বিক্রি করে জীবন-জিবীকা চলে। আমার বয়স হয়েছে, এখনো মুড়ি ভাজা বাদ দেইনি। এই যে আমি অসুস্থ ডাক্তারে কইছে এক্কেবারে আগুনের কাছে যাওয়া যাবো না। কিন্তু কি করমু আগুনে যদি না যাই তাইলে খামু কি। সরকার যদি আমাদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দিতো তাহলে আমরা ভালো করে চলতে পারতাম।

মুড়ি ব্যবসায়ী গোস্টদেবনাথ বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে মুড়ি ব্যবসায় জড়িত। হাতে ভাজা এই মুড়িতে কোনো রকম ভেজাল নেই। এই মুড়িতে শুধু লবণ-পানি ছাড়া আর কিছু দেয়া হয় না। তাই এই ফিংড়ীর হাতে ভাজা মুড়ির অনেক স্বাদ ও মুড়ির চাহিদাও অনেক।

তিনি বলেন, দেশে গড়ে ওঠা মুড়ি কারখানায় মুড়ি তৈরি হওয়ায় এখন হাতে তৈরি মুড়ি শিল্প পিছিয়ে পড়ছে। কারখানায় তৈরি মুড়ি দেখতে সাদা ধবধবে হলেও দুদিন ঘরে রাখলেই চুপসে যায়। এসব মুড়ি খোলা অবস্থায় প্রতি কেজি ৬৫ টাকা এবং প্যাকেটজাতগুলো ৭৫ টাকায় পাওয়া যায়। যা হাতে তৈরি মুড়ির দামের চেয়ে কম। তাই হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রির ক্ষেত্রে লাভ তো দূরের কথা আসল দামই তুলতে পারেন না মুড়ির কারিগররা।

এছাড়া পুঁজির অভাব ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছে না এ গ্রামের নারীরা। তাদের তৈরি ভেজালমুক্ত মুড়ির চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করতে পারছে না তারা। আর কেউবা ব্যবসায় টিকতে না পেরে অন্য পেশায় চলে গেছে।

আশাশুনি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. অরুণ কুমার ব্যানার্জী বলেন, প্রতি ১০০ গ্রাম পরিমাণ মুড়িতে রয়েছে ৪০২ গ্রাম ক্যালরি, ৮৯.৮ গ্রাম শর্করা, ০.৫ গ্রাম ফ্যাট, কোলেস্টেরল নেই, ৬.৩ গ্রাম প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ৬ মি.গ্রা, ফসফরাস- ৬ মি.গ্রা, সোডিয়াম ৩ মি.গ্রা.। মানবদেহের জন্য এই পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ মুড়ি অনেক সহায়ক ও উপকারী। হাতে ভাজা ভেজালমুক্ত মুড়ি খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)