দুর্নীতির বেঁড়াজালে শ্যামনগর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস
উপজেলার ৮৭ নং মানিকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন মোঃ আজিজুল হক। গত ১০ জুন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ঘোষণায় আরও অসংখ্যা শিক্ষককের মত তাকেও প্রধান শিক্ষক পদে পদায়ন করা হয়।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে শ্যামনগর উপজেলায় পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকদের একটি তালিকা পাঠানো হয় শ্যামনগর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে। যেখানে অপরাপরদের মত আজিজুল হককে ১০২ নং গোনা বিদ্যালয়ে এবং ১৭ নং নুরনগর বিদ্যালয় হতে রাবেয়া খলিলকে ১৮৬ নং দক্ষিণ কুলতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পদায়ন করা হয়। যথাযথ নিয়ম মেনে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদ্বয় নির্দেশিত প্রতিষ্ঠানে যোগদানও করেন।
কিন্তু আকিস্মকভাবে দুই দিন পার হতেই উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে আজিজুল হককে ১৮৬ নং কুলতলীতে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। বিপরীতে জেলা অফিস হতে প্রেরিত তালিকা মতে ১৮৬ নং বিদ্যালয়ে যোগদানের নির্দেশনা পাওয়া রাবেয়া খলিলকে ১০২ গোনা বিদ্যালয়ে যোগদানের অনুমতি দেয়া হয়।
বিষয়টি জানাজানি হতেই আজিজুল হকসহ অসংখ্যা শিক্ষকের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়। কেননা পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকদের পছন্দের বিদ্যালয়ে যোগদানের সুযোগ করে দেয়ার শর্তে শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসের দালাল খ্যাত দুই শিক্ষক নেতার মাধ্যমে উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবুল বাসার বিভিন্ন জনের থেকে আট লাখ টাকা গ্রহণ করে।
উল্লেখ্য শুরুতে ২০ নং রমজাননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানের সুযোগ করে দেয়ার শর্তে স্বয়ং উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবুল বাসার নগদে আজিজুল হকের থেকে এক লাখ টাকা গ্রহণ করেন বলে পদায়নের আগেই অভিযোগ ছিল। একইভাবে মিজানুর রহমানকে পদোন্নতি সাপেক্ষে ১১৫ নং ঝুরঝুরিয়া বিদ্যালয়ে যোগদানের সুযোগ দেয়ার শর্তেও নগদ ষাট হাজার টাকা গ্রহণ করেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার।
ফলে পছন্দের ও প্রতিশ্রুত প্রতিষ্ঠানে যোগদানের সুযোগ না পাওয়ায় ভুক্তোভোগী শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে পদায়নের পরও টাকা দিয়ে প্রতিশ্রুত প্রতিষ্ঠানে যোগদানের সুযোগ না পেয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা গত ১৮ জুন উপজেলা শিক্ষা অফিসে জড়ো হয়। এক পর্যায়ে তারা উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবুল বাসারের নিকট প্রদত্ত ঘুষের টাকা ফেরত দাবি করে।
বিষয়টি নিয়ে দারুণ বেকায়দায় পড়ে যাওয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসার তার গুণধর দুই শিক্ষক প্রতিনিধি নেতাদের শরানাপন্ন হয়। এক পর্যায়ে তারাও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে সমবেত হলে তীব্র বাদানুবাদ এবং উচ্চবাচ্যের ঘটনা ঘটে। এসময় শিক্ষক নেতাদের মধ্যস্থতায় টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি পেয়ে আর্থিক ক্ষতির শিকার শিক্ষকরা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ত্যাগ করে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত শিক্ষকদের কয়েকজন বলেন, ঘুষ হিসেবে হাতিয়ে নেয়া টাকা ফেরত না দেয়ার কৌশল হিসেবে শিক্ষা অফিসের দালাল খ্যাত দুই শিক্ষক প্রতিনিধির পরামর্শে কতিপয় শিক্ষকের হাতে শিক্ষা অফিসার লাঞ্ছিত হওয়ার প্রচারণা চালানো হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে বর্তমান উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শ্যামনগরে যোগদানের শুরুতেই মাত্র দুই মাস আগে বদলী বাণিজ্যের মাধ্যমে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এসময় তিনি সরাসরি টাকা হাতে না নিলেও “প” এবং “মা” আদ্যক্ষরের দুই শিক্ষক নেতার মাধ্যমে সমুদয় টাকা আদায় করেন। নির্দিষ্ট কমিশনের মাধ্যমে এ দুই নেতা দীর্ঘদিন ধরে শ্যামনগরে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের পক্ষে যাবতীয় আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেন বলে সর্বমহলে প্রচারণা রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশ প্রহরী নিয়োগ থেকে শুরু করে নিয়োগ ও বদলী বাণিজ্যসহ প্রশ্নপত্র কেন্দ্রিক দুর্নীতির সাথেও এ দুই শিক্ষক নেতা জড়িয়ে থাকেন মুলত শিক্ষা অফিসের প্রতিনিধি হিসেবে। অভিযোগ রয়েছে বিদ্যালয়ের শিক্ষা উপকরণসহ ছিলিপের মালামাল ক্রয় করার ক্ষেত্রে ঐ দুই শিক্ষক নেতার সহায়তা নেয়ার নির্দেশনা অনেক আগে থেকে চলে আসছে।
আরও অভিযোগ রয়েছে অতি সম্প্রতি একই পরিবারের দুই শিক্ষক (মা ও মেয়ে) এর মধ্যে কর্মস্থল পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবুল বাসার আশি হাজার টাকা দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত ষাট হাজার টাকায় দফারফা সারেন ।
ভুক্তভোগী অসংখ্যা শিক্ষকের দাবি সদ্য যোগদানকৃত উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবুল বাসারের শ্যামনগরে যোগদানের পর থেকে ঐ দুই শিক্ষক নেতার ঔদ্ধ্যর্ত দারুণ বেড়ে গেছে। মাত্র দুই মাস আগে বদলী বাণিজ্যের মাধ্যমে বার লাখ টাকা আদায়ের পর এবার পদায়ন বাণিজ্যে আরও আট লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা।
এসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলার জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবুল বাসারের ০১৭২১৩৬৪৫৬৪ সাথে মুঠোফোনে গত মঙ্গলবার থেকে বুধবার পর্যন্ত যোগাযোগ করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। অফিস থেকে জানানো হয় তিনি ছুটিতে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ রুহুল আমিন বলেন, ঐ দিনের ঘটনা দুঃখজনক। স্থানীয়দের মাধ্যমে জেনেছি ঐ শিক্ষক শিক্ষা অফিসারকে মারপিট করেছে যা গুরুতর অন্যায়। তবে এমুহূর্তে অভিযুক্ত ঐ শিক্ষক রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন স্থানীয় এমপি বলেছেন শিক্ষকের অপরাধ হলে আপনারা ব্যবস্থা নেন।
উপজেলা শিক্ষা অফিসারের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ঘুষ দেয়া ও নেয়া সমান অপরাধ। তাই ঐ ঘুষের অভিযোগ প্রমাণ হলে দুজনকে শাস্তি পেতে হবে।
এদিকে ঘুষের টাকা ফেরত দেয়ার পরিবর্তে লাঞ্ছিত হওয়ার প্রচারণা চালিয়ে ফায়দা লুটতে চাওয়া দুর্নীতিবাজ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্তপুর্বক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসের কার্যক্রম নিয়ে দুদকের আন্তরিক হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ভুক্তোভোগী শিক্ষকগন।