মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। পণ্ডিতরা বাংলা সাহিত্যের যুগকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক যুগ। প্রাচীন যুগের সময়কাল ৬৫৯ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ, মধ্যযুগের সময়কাল ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ এবং ১৮০১ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত যে যুগ চলছে, তাকে বলা হয় আধুনিক যুগ। তবে পণ্ডিতদের মাঝে মধ্যযুগকে নিয়ে নানা কথাবার্তা ও ধারণা রয়েছে। কেউ কেউ একে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলে থাকেন। ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করার পর এই ভারতীয় উপমহাদেশে আসে মুসলমান। তাদের আসার কারণ ছিল বাণিজ্য, সমুদ্র বিজয় এবং উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার। পণ্ডিতদের মতে, এই সময়ে সাহিত্যে তেমন কোনো অবদান মুসলমানদের দ্বারা রচিত হয়নি। তবে শূন্য পুরাণ, কলিমা জালাল, ডাক ও খনার বচন, সেক শুভোদয়া ইত্যাদি সাহিত্যকর্মের দিকে তাকিয়ে আমরা দেখতে পাই কথাটি আসলে সত্য নয়।
মহাকবি আলাওল ছিলেন এই মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি ঠিক কখন জন্মেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে, তার জন্ম ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে, কারো মতে তার জন্ম ১৬০৫ কিংবা ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে। এমনকি তার জন্মস্থান নিয়েও দু’ধরনের কথা রয়েছে। আবার কারো মতে তার জন্ম ফরিদপুর জেলার ফতেহাবাদের জালালপুরে, অনেকের ধারণা তার জন্ম চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে। তবে তার জন্মস্থান নিয়ে আলোচনার সময় পণ্ডিতগণ তার রচিত কিছু চরণ সামনে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায় যে তিনি জালালপুরেই জন্মেছিলেন। আলাওল তার পদ্মাবতী কাব্যে নিজ সম্পর্কে বলেন-
মুলুক ফতেয়াবাদ গৌড়েতে প্রধান।
তাহাতে জালাল পুর অতি পূণ্যস্থান।।
বহুগুণবন্ত বৈসে খলিফা ওলেমা।
কথেক কহিব সেই দেশের মহিমা।।
মজলিস কুতুব তখত অধিপতি।
মুই দীনহীন তান অমাত্য সন্তুতি।।
আরাকানের প্রথম মুসলিম কবি ছিলেন দৌলত কাজী। তার রচিত সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী সাহিত্যের একটি অন্যতম সংযোজন। আরাকান শব্দটি এসেছে রোসাঙ্গ থেকে, যার মানে হচ্ছে দৈত্যের অঞ্চল। এই আরাকানেই প্রথম মানুষকে নিয়ে সাহিত্য রচিত হয়। কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় সে কখনো আরাকানে গিয়েছিল কিনা, নিশ্চিত মাথা চুলকাতে শুরু করবে। আর যদি প্রশ্ন করা হয় যে চট্টগ্রামে গিয়েছিল কিনা, তাহলে মুখ হয়ে উঠবে উজ্জ্বল। অর্থাৎ, আরাকানের বর্তমান নাম হচ্ছে চট্টগ্রাম। আরাকানের শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয় আলাওলকে। তিনি যখন সাহিত্য রচনা শুরু করেন, তখন আরাকানের রাজা ছিলেন সুধর্মা, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কোরেশী মাগন ঠাকুর। এই মাগন ঠাকুরের ছায়াতলে থেকেই আলাওলের সাহিত্য জগতে শুভসূচনা হয়।
আলাওল ছিলেন একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত কবি। তার পিতা ফতেহাবাদের রাজ্যেশ্বর মজলিশ কুতুবের মন্ত্রী ছিলেন। কিশোর বয়সে বাবার সঙ্গে যাত্রাভিমুখে হার্মাদ জলদস্যুর কবলে পড়েন তিনি। বাবাকে হত্যা করা হয়, আহত আলাওল ভাগ্যের ফেরে চলে আসেন আরাকানে। এখানে তিনি মগরাজার সেনাবাহিনীতে রাজ-আসোয়ারের চাকরি গ্রহণ করেন। রাজ আসোয়ারের অর্থ হচ্ছে অশ্বারোহী সৈনিক। এখানে সৈনিকদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে তাদের মাঝে একজন আছেন, যিনি মুখে মুখে পদ রচনা করতে পারেন। জানতে পেরে কোরেশী মাগন ঠাকুর তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তখনকার আরাকান রাজসভা ছিল শিল্প সাহিত্যের অনুরাগীদের জন্য একটি চমৎকার পরিবেশ। এখানে গুণ এবং গুণী- দুইয়েরই কদর করা হতো। কে কোন ধর্ম পালন করছেন, সেটি মূল বিবেচ্য কখননোই হতো না। কবি বলেন,
বহু বহু মুসলমান রোসাঙ্গে বৈসন্ত। সদাচারী, কুলীন, পণ্ডিত, গুণবন্ত।।
১৬৫১ থেকে ১৬৭৩ পর্যন্ত আলাওল বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। প্রথমটির নাম ছিল পদ্মাবতী। প্রখ্যাত হিন্দি কবি মালিক মুহাম্মদ জায়সী ‘পদুমাবত’ কাব্যের বঙ্গানুবাদ। ১৬৫১ খৃস্টাব্দে মাগন ঠাকুরের নির্দেশে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ অনুবাদ করেন। এ কাব্যটি আলাওলের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য। বেশ কিছু ভাষা আলাওলের দখলে ছিল। যার ফলে অনুবাদ তার জন্য বেশ সহজ ছিল। তিনি মৈথিল, ব্রজভাষা, ঠেট, খাড়িবোলির মত উত্তর ভারতের উপভাষা ছাড়াও বাংলা, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসিতে সমান দখল রাখতেন। অপর দিকে, তাসাউফ ও যোগতন্ত্রেও ছিলেন নিপুণ। তবে এই সময়টায় তার ওপর বেশ কিছু ঝড় বয়ে যায়। রাজসভায় সকলে তাকে ভালো নজরে দেখতেন না। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে শাহ সুজা বিতাড়িত হয়ে চলে আসেন আরাকান রাজ্যে। নিহত হন ১৬৯১ সালে। আলাওল এই সময়ে রাজসভার অনেকেরই বিরাগভাজন হয়ে কারারুদ্ধ হন। পঞ্চাশদিন কারাবাস ভোগ করবার পর তিনি মুক্তি পান। এই সময় তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক কোরেশী মাগন ঠাকুরের মৃত্যু হলে আরো বেকায়দায় পড়ে যান তিনি। কিছুদিন ভিক্ষাবৃত্তিও করতে হয় তাকে। সৈয়দ মুসা, সৈয়দ মুহম্মদ খান, নবরাজ মজলিশ, শ্রীমন্ত সোলেমান প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের নজরে তিনি আসবার পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। তার মতো অনুবাদক বাংলা সাহিত্যে বিরল। কাব্যতত্ত্ব, অলঙ্কারশাস্ত্র, ছন্দবিজ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল তুলনাহীন। সংস্কৃত ছন্দেও তিনি অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে বাংলা প্রয়োগ করতেন। আলাওলের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক-
১. পদ্মাবতী: প্রখ্যাত হিন্দি কবি মালিম মুহাম্মদ জায়সী ‘পদুমাবত’ কাব্যের বঙ্গানুবাদ। ১৬৫১ খৃস্টাব্দে মাগন ঠাকুরের নির্দেশে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ অনুবাদ করেন। এ কাব্যটি আলাওলের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য।
২. সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামান: আলাওলের দ্বিতীয় কাব্য। ১৬৫৮ খৃস্টাব্দে মাগন ঠাকুরের পরামর্শে ও উৎসাহে এ কাব্য লেখা শুরু করেন এবং পরে ১৬৬৯ খৃস্টাব্দে রোসাঙ্গ রাজের আমত্য সৈয়দ মূসার অনুরোধক্রমে তা সমাপ্ত করেন। এটি প্রেম মূলক কাহিনী কাব্য।
৩. সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী: দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য আমত্য সুলায়মানের অনুরোধে ও উৎসাহে ১৬৫৯ খৃস্টাব্দে সমাপ্ত করেন। এ কাব্যগ্রন্থটি আলাওলের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ।
৪. সপ্তপয়কার: পারস্য কবি নিজামীর সপ্তপয়কর নামক কাব্যের ভাবানুবাদ। রোসাঙ্গরাজের সমরমন্ত্রী সৈয়দ মুহাম্মদের আদেশে ১৬৬০ খৃস্টাব্দে আলাওল এটির অনুবাদ করেন। কাব্যে রসুল বন্দনার প্রসঙ্গে আলাওল লিখেছেন:
আদ্যেতি নিরুপ ছিল প্রভূর নির্বাকার।
চেতন স্বরুপ যদি হইল প্রচার।।
অতি ঘোরতর তমঃআকার বর্জিত।
মহা জ্যোতিমংয় হৈল আল্লার-ঈঙ্গিত।।
জ্যোতি সমুদ্রে আদ্যি নুর মহাম্মদ।
জগৎ বিজয়ী হৈতে পাইল সম্পদ।।
সপ্ত স্বর্গ উদ্যানের আদ্য নব ফুল।
বৃদ্ধি বাক্যে শিরোমণি ভূবনে অতুল।।
সেই পুস্প হৈতে আদ্যে আদম উজ্জল।
সকল কদর্মপূর্ণ সে-ই নির্মল।
৫. তোহফা: এটি আলাওলের পঞ্চম রচনা। ১৬৬৪ খৃস্টাব্দে আলাওল এ কাব্যগ্রন্থটি সমাপ্ত করেন। এটি আলাওলের পঞ্চম রচনা। এ গ্রন্থটিও অনুবাদ। বিখ্যাত সূফী সাধক শেখ ইউসুফ গদা দেহলভীর ‘তোহফাতুন নেসায়েহ’ নামক ফরাসী গ্রন্থের অনুবাদ।
৬. সেকান্দর নামা: এ ষষ্ঠ নম্বর কাব্যটি নিজামী গঞ্জভীর ফারসী সেকান্দর নামা গ্রন্থের অনুবাদ। আলাওল এ কাব্যটি সম্ভবত ১৬৭২ খৃস্টাব্দে রচনা করেন। আরাকান রাজ চন্দ্র সুধর্মার নবরাজ উপাধীধারী মজলিস নামক জনৈক আমত্যের অনুরোধে আলাওল সেকান্দরনামা অনুবাদ করেন।
১৬৭৩ সালে মহান এই কবি মৃত্যুবরণ করেন। তার বেশিরভাগ কর্ম অনুবাদ হলেও সেগুলোকে মৌলিক রচনার সমপর্যায়ে নন্দিত করা হয়েছে।