এশিয়ার ইয়াবা বিস্ফোরণ
‘ব্রেকিং ব্যাড’- খুব জনপ্রিয় একটি ইংরেজি টিভি সিরিজের নাম। যারা সিরিজটি দেখেছেন, তাদের কাছে মেথ বা মেথামফেটামিন একটি পরিচিত নাম। এটি একটি ড্রাগ যার নানা রকম ফরমেশন রয়েছে। এশিয়ার মেথ সংস্কৃতির ভিত্তি কিন্তু এ থেকে ভিন্ন। এখানকার মাদক আতঙ্কের নাম ইয়াবা। এটি একটি থাই শব্দ, যার অর্থ ‘ম্যাড ড্রাগ’। পূর্বে এটি ইয়ামা নামে পরিচিত ছিলো। ইয়াবা একটি ট্যাবলেট জাতীয় ওষুধ, যার মূল উপাদান হলো মেথামফেটাইন এবং ক্যাফেইন। এশিয়ায় ইয়াবার রাজত্ব নিয়ে সিএনএনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের চুম্বক অংশ ডেইলি বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য উন্মোচন করা হলো-
মিয়ানমারের প্রত্যন্ত জঙ্গল থেকে শুরু করে হংকং এর আলো ঝলমলে রাস্তা- এশিয়ার সর্বত্র পুলিশের সঙ্গে মেথামফেটামিনের লড়াই চলছে। অনেক লক্ষণ থেকে ধারণা পাওয়া যায়, এই লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনী। ক্রিস্টাল মেথ ও ইয়াবার চাহিদা এখানে আকাশচুম্বী। এই মাদকের উৎপাদনও তাই বেড়ে চলছে দিনকে দিন। এর সঙ্গে বাড়ছে মাদক সহিংসতা, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লাশের সংখ্যাও। বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের মতো দেশের নেতারা এই প্রাণনাশী মাদক যুদ্ধে মদদ দিচ্ছেন। আর শত শত মানুষের প্রাণনাশ হচ্ছে এ কারণেই।
কিন্তু এটি ‘ব্রেকিং ব্যাড’ এর কোনো প্লট নয়। শুধুমাত্র গরীব ও নিপীড়িত মানুষরাই এখানে মেথ এর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন না। জাতিসংঘের অফিস অন ড্রাগস এন্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) এর দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের কর্মকাণ্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জেরেমি ডগলাস এর ভাষ্যমতে, মেথ এর বিষয়ে এশিয়াতে কোনো বৈষম্য নেই। বয়স, শ্রেণী, লিঙ্গভেদে এই মাদক এখন এশিয়া জুড়ে সব ধরণের মাদকসেবীদের কাছে সমান জনপ্রিয়। ডগলাস আরো বলেন, এশিয়াতে তার দীর্ঘ ১৬ জীবনের কর্মজীবনে তিনি কখনো মেথামফেটামিন এর এত চাহিদা লক্ষ্য করেননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই অঞ্চলের মাদক ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ও ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বেশ সুবিধাজনক স্থানে রয়েছেন। এশিয়ার এই বিপুল মেথ উৎপাদনের কারখানাগুলো লুকিয়ে আছে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল নামক থাইল্যান্ড, লাওস ও মিয়ানমার এই তিন দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়, এখানকার প্রত্যন্ত সব জঙ্গলের ভেতরে, যেখানে আইনের শাসন বলতে কিছু নেই। গোপনে মাদক উৎপাদন এবং স্বল্প সময়ের নোটিশে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালানোর জন্য জায়গাটি আদর্শ। মাদক ব্যবসা থেকে আগত কোটি কোটি ডলার আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করে বৈধ করে নেয়া হচ্ছে।
এ পর্যন্ত এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে যে পরিমাণ ইয়াবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, তার সিংহভাগের উৎপাদনস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে উত্তর মায়ানমারের শান রাজ্যকে। পপি উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া এবং আইন প্রয়োগে শৈথিল্য- উভয়ের জন্যই যে এলাকা ‘কুখ্যাত’! বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনী ও তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকরা এ কুকর্মে মদদ দিয়ে আসছে। এদের মধ্যে ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (ইউডাব্লিউএসএ) এবং তাদের রাজনৈতিক সহযোগী ইউনাইটেড ওয়া স্টেট পার্টি সবচেয়ে এগিয়ে। এরা বহু বছর ধরে স্থানীয় ওয়া নৃগোষ্ঠীদের স্বাধীনতা কায়েমের চেষ্টায় রয়েছে। ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মিতে সৈন্য সংখ্যা ৩০ হাজারে পৌঁছেছে!
মাদক উৎপাদন ও চোরাচালানের ফলে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে এই বিশাল বাহিনীর ভরণপোষণ চলে বলে মনে করা হয়। তবে এর সত্যতা যাচাই করা একপ্রকার অসম্ভবই বলা চলে। উত্তর শান প্রদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্ভেদ্য স্থানগুলোর একটি। অনেকে তো ঠাট্টা করে বলে থাকেন, এর চেয়ে উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশ করা সহজ! ২০১৬ সালে একবার ইউডাব্লিউএসএ কিছু সাংবাদিককে অল্প কিছুক্ষণের জন্য ওই অঞ্চল ঘুরে দেখার সুযোগ দেয়, যদিও মাদক চোরাচালানের অভিযোগ তারা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল এলাকা একদা হেরোইন উৎপাদন ও চোরাচালানের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত চাহিদার কারণে এখানকার মাদক ব্যবসায়ীরা হেরোইন ছেড়ে মেথামফেটামিনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার চাহিদা ছাড়াও ইউডাব্লিউএসএ’র এই ‘মেথ গেম’ এর পেছনে ক্রীড়নক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে উচ্চ লাভ এবং ইয়াবার তুলনামূলক সহজ ও সস্তা উৎপাদনযোগ্যতা।
ইয়াবা একটি সিন্থেটিক ড্রাগ। ল্যাবরেটরিতে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিক ব্যবহার করে এটি উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য পপি বা অন্য কোনো উদ্ভিদ চাষ করার প্রয়োজন হয় না, হেরোইনের ক্ষেত্রে যেমনটা দরকার হয়। মেথ ল্যাবরেটরিগুলো সহজেই ঢেকে ফেলা বা স্থানান্তর করা সম্ভব, পপি বা মারিজুয়ানার ক্ষেতের ক্ষেত্রে যেটা একেবারেই সম্ভব নয়। এতেই বোঝা যায়, অন্যান্য মাদকের তুলনায় ইয়াবা বা মেথামফেটামাইনের উৎপাদন কতটা সহজ!
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে সহজেই ইয়াবা উৎপাদনের পর সেগুলো পরিবহনের কাজটা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। পূর্বে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত এলাকাগুলোর একটি। কিন্তু চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের পর অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। বড় ধরণের অবকাঠামোগত উন্নয়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে ওই এলাকায়। মিয়ানমারকে নিয়ে বেইজিং খুব বড় ধরণের পরিকল্পনা আঁটছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে চীনের স্থলবেষ্টিত ইউনান প্রদেশকে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সমুদ্রবন্দরগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য। এজন্য মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডকে পাখির চোখ করেছে চীন।
এই উন্নয়ন অনেকটা শাপে বর হয়ে এসেছে এই অঞ্চলের মাদক চোরাচালানকারীদের জন্য। মাদক পাচারের জন্য তারা এসব উন্নত রাস্তাঘাট ব্যবহার করছে, মাদকের পরিবহন হয়ে গেছে অনেক সহজ। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে উত্তর মিয়ানমারে উৎপাদিত ক্রিস্টাল মেথ ও ইয়াবা জাপান, নিউজিল্যান্ড এমনকি অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে! ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ প্রায় আশি কোটি ডলার সমমূল্যের ইয়াবার একটি চালান আটক করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এগুলোও ছিলো মিয়ানমারের শান প্রদেশ থেকে আগত। মহাদেশীয় সীমানা পেরিয়ে এশিয়ায় উৎপাদিত মেথামফেটামিনের ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়ছে মহামারীর মত।