ভিন্ন ধর্মী সংবর্ধনায় বিপাকে যশোর-২ আসনের সাংসদ
ফুলের মালা হাতে নিয়ে ক’জন শিক্ষার্থী উঠছে-বসছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে দেশাত্মবোধক গান ‘ধনধান্যে পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’। ঠিক সামনে চেয়ারে আসীন সংসদ সদস্যসহ আরও বেশ কয়েকজন। শিক্ষার্থীরা দাঁড়াল, হাঁটু গেড়ে বসল, এভাবে ছয়-সাত বার; তারপর অতিথির গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে হাতজোড় শেষে গিয়ে বসে নিজের আসনে- এমন ঘটনা জুড়ে দেওয়া একটা ভিডিওচিত্র অনলাইনে ভাইরাল হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পর্যায়ের এবং সেটা বিদ্যালয়ের একটা কক্ষে। সামনে উপবিষ্ট জন যিনি তিনি যশোর-২ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মনির। এই ভিডিওচিত্র ফেসবুকে প্রথমে আপলোড করেন সাংসদ নিজেই। পরে এই ভিডিওচিত্র নিয়ে অনলাইনে তুমুল সমালোচনা শুরু হলে সেটা ডিলিট করেও দেন তিনি। নিজের ব্যক্তিগত আইডি থেকে ডিলিট করলেও ততক্ষণে সেটা অনলাইনে ভাইরাল হয়ে যায়, এবং মুছে দেওয়ার আগে তার টাইমলাইন থেকে অন্য একজন ফেসবুকে সেটা আপলোড করেন।
এমন অবস্থায় সরকারদলীয় ওই সাংসদ ফেসবুকে তোপের মুখে পড়েন। অনলাইনের মানবিক ব্যবহারকারীরা প্রবল সমালোচনা করেন ওই সাংসদের। এই সমালোচনার মধ্যে দল-নির্দল কোনোকিছু ছিল না। শিশু নির্যাতন হিসেবেও দেখেন অনেকেই। সাইবার কাঠগড়ায় উঠে আসেন সাংসদ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওই সাংসদ তার ফেসবুকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে স্ট্যাটাস দেন। তার ভাষ্য, ‘একজন অতিথির পক্ষে কোনভাবেই জানা সম্ভব নয় যে স্টেজে কী পারফর্ম হবে।’ সাদাচোখে বিশ্লেষণে গেলে বলা যায় সাংসদের কথাও ঠিক, তার অনুষ্ঠানে কী হবে সেটা আগে থেকে তার অজানা থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তবে এখানে কথা থাকে, পরে তো দেখেছেন- কী হতে চলেছে এবং হচ্ছে; এমনকি হয়ে যাওয়ার পরেও নিজেকে সেই ভিডিওচিত্র ফেসবুকে প্রচারের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বুঝতে পারেননি কী হয়েছে সেখানে আদতে। ‘আমাদের এমপিরা, রাজনীতিকরা তো নিজেদের এমন সামন্তপ্রভুই মনে করেন’ ফেসবুকে এরকমই মন্তব্য করেছেন প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর। এর বাইরে অগণন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইনে। এতে করে তার ভূমিকা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, ঠিক তেমনি নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সরকারি দল আওয়ামী লীগও সমালোচনার মুখে পড়েছে।
ইত্যকার সমালোচনার মধ্যে সাংসদের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্যে দেখা যায়, ‘আমাকে এবং জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান জানাতে ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে বিনম্র শ্রদ্ধায় ফুলেল শুভেচ্ছা জানায় স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে স্কুল মাঠে শিক্ষার্থীদের ঐ ডিসপ্লেটি করা সম্ভব হয়নি। একারণে প্রধান শিক্ষকের পীড়াপিড়িতে এক পর্যায়ে স্কুলের ক্লাসরুমের ভেতরে স্বল্প পরিমাণ জায়গায় ডিসপ্লেটি করে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। ডিসপ্লের সামনে জায়গা না থাকায় এবং অতিথিদের আসন ডিসপ্লের নিকটে হওয়ায় ডিসপ্লেটি দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে ভিডিওতে।’
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে এধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এবং স্থানাভাবে বিষয়টি দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছে বলে সাংসদ মনিরুল ইসলাম পুরো বিষয়টিকে ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সেই যুক্তি আদতে টেকে না অনলাইনের এই সমালোচনাকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যাদানসহ নানা কারণে। একই সঙ্গে তার দাবি ‘এই ভিডিওটি নিয়ে কিছু কুচক্রী মহল জাতীয় সংসদের একজন সদস্যের সম্মান ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে’। এ বক্তব্যে তিনি সরাসরি অভিযুক্ত করছেন সমালোচনাকারীদের এবং তাদেরকে আখ্যা দিচ্ছেন ‘কুচক্রী মহল’ হিসেবে। এটা অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত; যদি তিনি এজন্য ক্ষমাও চেয়েছেন সকলের কাছে। এই ক্ষমা চাওয়া, কুচক্রী মহল হিসেবে আখ্যা দানের সঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমালোচনা বলে দাবি করাটা পূর্বোক্ত দাবিকৃত তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এবং এটাই প্রমাণ করে তিনি জেনেবুঝে এমনটাই করেছেন এবং সেজন্যে প্রকৃতই তিনি অনুশোচিত নন।
সাংসদ দাবি করেছেন, ‘ভেন্না পাতার চেয়েও খারাপ টিনের ছাপরা ছিল চৌগাছা উপজেলার হাকিমপুর ইউনিয়নের এবিসিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ সেখানে তিনি পাকা দালান করে দিয়েছেন। এই পাকাদালান করে দেওয়ার কারণেই তিনি কি তবে এমন সংবর্ধনা ডিজার্ভ করছেন? এই ভিডিওয়ের সমালোচনাকারীদের অধিকাংশই তার নির্বাচনী এলাকার লোক নন, তবু এই সমালোচনাকে বলছেন ‘কু-রাজনীতি’ কিন্তু বাস্তবতা হলো এই আলোচনায় আসার আগে সারাদেশের না হোক অন্তত ফেসবুকে ক’জনই বা চিনত তাকে? অধিকাংশেরই না চেনার কথা তাকে; এবং আমিও চিনতাম না।
অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মনিরের যে পরিচয় গণমাধ্যমে এসেছে তিনি যশোর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। একটা জেলা শহরের রাজনীতিবিদ হিসেবে খুব বড় যে পরিচিতি তা নয়, তাই এমন পরিচয়ের কাউকে অনলাইনবাসী প্রতিপক্ষ ভাববে সেটা অপ্রয়োজনীয় ভাবনা। তাই তাকে নিয়ে এখানে কোনো কু-রাজনীতি হয়নি, তার সম্মান ক্ষুণ্ণ করতে কেউ অপচেষ্টা করেনি, এই সমালোচনাও তাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমালোচনা নয়; এটা মূলত দৃষ্টিকটু ও আপত্তিকর পন্থায় সংবর্ধনা নেওয়ারই প্রতিক্রিয়া।
সাংসদ মনিরুল ইসলাম এই সংবর্ধনার রীতি নিয়ে একদিকে যেমন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর দায় দিয়েছেন, ক্ষমা চেয়েছেন, ঠিক একই ঘটনায় তিনি সমালোচকদের একহাত নিয়েছেন। এর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি তাই হালকা হয়ে যায়। এতখানি তিনি না করলেও পারতেন, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মতোই।
আমাদের দুঃখ যে, নেতা-সাংসদ-মন্ত্রী হয়ে গেলে অনেকেই ধরাকে সরা জ্ঞান করে থাকেন। এই ঘটনা আগেকার অনেকগুলো ঘটনার আরও এক সংযুক্তি বিশেষ। অথচ নেতা কিংবা সাংসদদের আবার জনগণের কাছে ফিরে যেতে হয় অন্তত পাঁচ বছরে হলেও একবার, এবং সেটা ভোটের সময়ে। এই সময়ে নেতা কিংবা সাংসদদের চাইতে জনগণই ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে- এটা ভুলে যান অনেকেই। এই ভুলে যাওয়াটা অভ্যাসের অংশ অনেকের।
এঘটনা বাদ দিলেও অনেক সাংসদ কিংবা মন্ত্রীকে ধরতে অথবা যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেককে ব্যক্তিগত সহকারীদের কাছে ধর্না দিতে হয়। এনিয়ে আমার কাছে বেশ প্রমাণও রয়েছে। অনেক জায়গায় মন্ত্রী-সাংসদের অবস্থানগত অনুপস্থিতি কিংবা দূরত্বের কারণে ব্যক্তিগত সহকারীর নাম নিয়ে অনেকেই হর্তাকর্তা সেজে বসে আছেন।
যশোরের এবিসিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভবন কিংবা আরও কিছু প্রস্তাব পাস করতে হয়ত কর্তৃপক্ষ এমন তোষামোদের আশ্রয় নিয়েছেন এবং মেয়াদি কর্তা সেজে বসা অনেকেই এধরনের তোষামোদ পছন্দও করছেন; তা না হলে এমন ঘটনা ঘটবে কেন?
এই যে ধারা চলমান এটা কোনোভাবেই অব্যাহত রাখা যাবে না। এজন্য আমাদের নিজেদের এবং জনপ্রতিনিধিদের মধ্যকার একটা সুস্থ ধারার প্রবাহ ও সতর্কতা জরুরি। এখন অনলাইনের যুগে অপ্রত্যাশিত ও নেতিবাচক অনেক কিছুর বাইরে কিছু ইতিবাচক ঘটনাও ঘটে যেখানে মানুষের মানবিক রূপের প্রকাশ দৃশ্যমান হয়। যশোরের এই সংবর্ধনার ভিডিওচিত্রের গণ-প্রতিক্রিয়া আশাবাদী হওয়ার মতই। ধারণা করছি, সাংসদ মনিরুল ইসলাম মনির এটাকে রাজনৈতিক ভাষায় অম্লমধুর বাক্যপ্রয়োগের মাধ্যমে নিজের অন্যায়কে জায়েজকরণের যতই চেষ্টা করুন না কেন তিনি নিজেও এনিয়ে ভবিষ্যতে সতর্ক হবেন এবং এধরনের ঘটনা হয়ত এটাই শেষ তার জীবনের। কারণ গণপ্রতিক্রিয়ায় যা উঠে এসেছে সেটা কোনোভাবেই তার পক্ষে যায়নি, যাওয়ার কথাও নয়।
অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনার দায় এড়াতে সাংসদের আগে থেকে জানতাম না বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নাই। তিনি আগে কিছু না জানলেও পরে জেনেছেন, দেখেছেন, উপভোগ করেছেন এবং সেটা ফেসবুকেও আপলোড করে দেশবাসীকে তার সেই ‘গর্বিত’ হওয়ার দৃশ্য দেখানোর সুযোগ নিয়ে পরে সমালোচনার মুখে সেটা মুছে দিয়ে এখন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি।