সাতক্ষীরায় কলেজ ছাত্র গৌতম হত্যার ৮ বছর

রঘুনাথ খাঁ:

সাতক্ষীরার চা ল্যকর মেধাবী কলেজ ছাত্র গৌতম সরকার হত্যার বুধবার আট বছর পূর্ণ হচ্ছে। চা ল্যকর এ মামলার চার আসামীর বিরুদ্ধে আদালত ফাঁসির আদেশ দেয়। দু’আসামী পলাতক ও উচ্চ আদালতে আপিলে ঝুলে আছে ফাঁসির কার্যকারিতা। ফাঁসির দন্ডাআদেশপ্রাপ্ত মহাদেবনগর গ্রামের সাজু শেখ ও শাওন ভারতে পালিয়ে গেলেও তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১০৮ বছরের বৃদ্ধা ঠাকুরমা কামিনী দাসী সরকার জীবদ্দশায় গৌতম হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর দেখার জন্য প্রহর গুনছেন ।

এদিকে অষ্টম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে বুধবার সন্ধ্যায় নিজ বাড়িতে ছোট আকারে স্মরনসভা শেষে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ইউপি নির্বাচনে প্রতিপক্ষ এক জামায়াত নেতার জামাতা চাঁদাবাজির অভিযোগে পুলিশের হাতে ২০১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলা বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টির এক সময়কার সক্রিয় সদস্য জামসেদ আলী আটক হন। তাকে ছাড়িয়ে আনতে না যাওয়ায় ১৩ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে বাড়ির পাশের রুহুল আমিনের দোকানে টিলিভিশনে খেলা দেখার সময় ঘোনা ইউপি সদস্য গনেশ সরকারের ছেলে মাহমুদপুর সীমান্ত ড্রিগী কলেজের রাষট্রবিজ্ঞানে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র গৌতম সরকারকে মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ না পেয়ে গালের মধ্যে গুলের কৌটা ঢুকিয়ে মুখে ক্রস টেপ মেরে হাত ও পা বেঁধে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পরে পার্শ্ববর্তী মোখলেছুর রহমানের নির্মাণাধীন বাড়ির পুকুরের জলের মধ্যে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দেহে ১২টি ইট ঝুলিয়ে লাশ গুম করার চেষ্টা করা হয়।

খোঁজাখুঁজির একপর্য়ায়ে ১৫ ডিসেম্বর দেবহাটা উপজেলার বহেরা খাস খামার এলাকা থেকে একটি রাম দা সহ আলী আহম্মেদ শাওন ও শাহাদাত হোসেনকে আটক করা হয়। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ি ১৬ ডিসেম্বর গনেশ সরকার বাদি হয়ে ভাড়–খালির শাহাদাৎ হোসেন, দেবহাটার বহেরা গ্রামের আলী আহম্মেদ শাওন, সদরের মহাদেবনগরের সাজু শেখ, নাজমুল হাসান, কবিরুল ইসলাম মিঠু ও মহসিন আলীর নাম উল্লেখ করে থানায় একটি অপহরণ ও হত্যা মামলা দায়ের করেন। গ্রেফতারকৃত শাওনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ি নাজমুল হাসান, সাজু শেখ ও মহসিনকে জনতার সহায়তায় আটক করা হয়। ১৭ ডিসেম্বর পুলিশ গৌতমের লাশ উদ্ধার করে। ওই দিন গনেশ সরকার বাদি হয়ে নুর আহম্মেদ মুক্ত, ওমর ফারুক ও জামসেদের নাম উল্লেখ করে থানায় সম্পুরক এজাহার দাখিল করেন। গ্রেফতারকৃত শাহাদাৎ ও নাজমুল হোসেন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
২৪ ডিসেম্বর ঘোনা ইউনিয়নবাসী চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে ও লাবনী মোড়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী যৌথভাবে সাতক্ষীরা সীমান্ত ডিগ্রী কলেজের সামনে এক বৃহৎ মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে । সমাবেশ থেকে গৌতম হত্যার সঙ্গে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার, সদর থানার তদন্ত ওসি আলমগীর কবীর ও উপপরিদর্শক আসাদুজ্জামানকে অপসারনের দাবি জানানো হয়। আসামী পক্ষের লোকজনের হুমকি দেওয়ায় ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি গনেশ সরকার সদর থানায় এক হাজার ১৬৬নং ও ১৬ ফেব্রæয়ারি ৮৫৭ নং সাধারণ ডায়েরী করেন। গৌতম হত্যার ভয়াবহতা নিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাতক্ষীরার বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সদর থানার উপপরিদর্শক আসাদুজ্জামানের হাত ঘুরে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক এসএম আশরাফুল আলমের উপর বর্তায় মামলার তদন্তভার। ২২ এপ্রিল শাহাদাৎ, নাজমুল, নূর আহম্মদ মুক্ত, ওমর ফারুক, সাজু হোসেন, ফজিলা খাতুন,মহসিন আলী, কবিরুল ইসলাম মিঠু, আলী আহম্মেদ শাওন ও জামসেদ আলীর নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন এসএম আশরাফুল আলম। একে একে মামলার সকল আসামী জেল হাজতে যায়। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন করে জামিন নিয়ে আলী আহম্মেদ শাওন পালিয়ে যায়। জামিন মুক্তি পেয়ে স্বপরিবারে পালিয়ে যায় সাজু শেখ। ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদার আসামী শাহাদাৎ হোসেন, সাজু শেখ, নাজমুল হোসেন ও আলী আহম্মেদ শাওনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করার নির্দেশ দেন। শাওন ও সাজু পলাতক থাকলেও জেল হাজতে থাকা শাহাদাৎ ও নাজমুল মহামান্য হাইকোর্টে দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন।

গণেশ সরকার জানান, তার ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যার বিচারের রায় কার্যকর না হওয়ায় গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ও তার পরিবারের সদস্যরা রয়েছে উৎকণ্ঠায়। তাছাড়া হত্যা মামলা চলাকালিন আসামী শাহাদাতের মা বাদি হয়ে তার ঘরবাড়ি ভাঙচুরও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ১২জন হিন্দুর নামে মামলা করেন। মামলার ১৩ জন সাক্ষী ছিল জামায়াতের লোক। এ ছাড়া ছেলের নির্মম মৃত্যুতে নিরাপত্তাজনিত কারণে মেয়ে প্রিয়া সরকারকে কলেজে পড়া বন্ধ করে দিয়ে বিয়ে দিতে হয়েছে। তিনি নিজেও পথে ঘাটে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেন না। বিগত ইউপি নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছেন ছেলে হত্যা মামলার আসামীদের স্বজনদের পরিকল্পনার কারণে ।উচ্চ আদালতে বিচারের যে জট তাতে তিনি জীবদ্দশায় আসামীদের শাস্তি দেখে যেতে পারবেন বলে মনে করেন না। তবে স্বপরিবারে ভারতে পালিয়ে থাকা সাজু শেখ ও আলী আহম্মেদ শাওনকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার যদি ব্যবস্থা না নেয় তাহলে তারা কোনদিনও বিচারের আওতায় আসবে না। গণেশ সরকার আরো বলেন, ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর রাত সাতটার দিকে তাকে ০১৯৭৫- ৬১২৭৫৫ নং মোবাইল থেকে হুমকি দিয়ে বিকাশে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। এ ঘটনায় থানায় ৯ ডিসেম্বর ৭৭৬ নং সাধারণ ডায়েরী করা হয়। প্রতি বছর মৃত্যু বার্ষিকী কাছাকাছি এলে হুমকি শুরু হয়। বর্তমানে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)