সেবার পরিবর্তে বাণিজ্যই যেন হয়ে উঠছে মুখ্য

 অনলাইন ডেস্ক :

জনগণের দান-অনুদানের অর্থে পরিচালিত চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল যেন দিন দিন ‘বাণিজ্যিক’ হাসপাতালে পরিণত হচ্ছে। সেবার পরিবর্তে এখানে বাণিজ্যই মুখ্য বিষয় হয়ে উঠছে। এখানে সেবা পেতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রোগী এবং তাদের স্বজনরা। কাউন্টারে সময়মতো টিকিট না পাওয়া, নিয়মিত ওয়ার্ডবয়ের অনুপস্থিতি, নার্সদের অসহযোগিতা, ডায়াগনসিসের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যসহ নানা ভোগান্তি এখন এ হাসপাতালের স্বাভাবিক চিত্র।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম নতুন ভবনে শুরু হওয়ার পর ভোগান্তি আরও বেড়েছে। সেবার মান না বেড়ে জটিল সব নিয়মকানুন ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে যাচ্ছে হাসপাতালের কার্যক্রম। অলাভজনক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠা এই হাসপাতালে হঠাৎ করেই বাড়ানো হয়েছে বেড ভাড়া থেকে শুরু করে সব ধরনের সেবার বিনিময় মূল্য।

নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ায় হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার চিত্রই ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি হাসপাতালের ছাদে ডেঙ্গুর প্রজননক্ষেত্র পেয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ অভিযোগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ১০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।

এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর স্বজন বন্দর থানার আনন্দবাজার এলাকার বাসিন্দা লিটন দেব যুগান্তরকে বলেন, ‘স্ট্রোক করায় আমার মায়ের মুখ বাঁকা হয়ে গেছে। মেডিসিন বিভাগে ভর্তি থাকায় সেখান থেকে ফিজিওথেরাপি দেওয়ার জন্য চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। সারা ওয়ার্ডে কেবল একজন ওয়ার্ডবয় দায়িত্ব পালন করে। তাকে ছাড়া ওয়ার্ড থেকে বের হওয়া যায় না। এ ছাড়া লিফটে ওঠার জন্য কমপক্ষে আধাঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। শত ডাকেও নার্সদের পাওয়া যায় না। সিরিঞ্জ থেকে শুরু করে সবকিছু কিনে দেওয়ার পরও বিল পরিশোধ করতে হয়েছে দুই হাজার ৭৬০ টাকা। কোনো কারণে চিকিৎসকদের পালাবদলের ফাঁদে পড়লে তো ভোগান্তির আর সীমা থাকে না।’

সরেজমিন নগরীর আগ্রাবাদের এ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, নিচতলার বহির্বিভাগ রোগীর কাউন্টারে আসন রয়েছে ৭টি এবং চিকিৎসা ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ টাকা আদায়ের ক্যাশ কাউন্টারে আসন রয়েছে ১০টি। অথচ বহির্বিভাগ কাউন্টারে দায়িত্ব পালন করছেন ৩ জন এবং ক্যাশ কাউন্টারে দুজন। বাকি সিটে লোক না থাকায় কাউন্টারের সামনে ছিল লম্বা লাইন।

চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীর স্বজনরা জানান, একজন রোগীকে দেখানোর জন্য প্রথমে বহির্বিভাগের কাউন্টার থেকে ১০০ টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক সেই রোগীকে দেখেন। এজন্য অপেক্ষা করতে হয় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে ভর্তির জন্য বলা হয়। এরপর নিচতলার ২৮ নম্বর কাউন্টারে রোগী ও তার স্বজনের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে ভর্তি করানো হয়। তারপর পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে। সেই ওয়ার্ডে যাওয়া থেকেই শুরু হয় হয়রানি। এরপর জরুরি পরীক্ষা এবং ওষুধ কিনতে বিভিন্ন স্লিপ দেওয়া হয় ওয়ার্ড থেকে। দফায় দফায় ওষুধ কিনতে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকা জমা দিতেই ক্লান্ত হয়ে যান স্বজনরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরেই সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি এবং চিকিৎসা দেওয়া হয় মা ও শিশু হাসপাতালে। এ হাসপাতালে এতদিন স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো। সম্প্রতি এর কার্যক্রম ১২ তলা নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে।

এরপর ঘোষণা ছাড়াই বেড ভাড়া থেকে শুরু করে সব সেবার মূল্য বাড়ানো হয়েছে। আগে সাধারণ বেডের ভাড়া যেখানে সাড়ে তিনশ টাকা রাখা হতো বর্তমানে সেই ভাড়া ৫০০ টাকা করা হয়েছে। একইভাবে বাড়ানো হয়েছে কেবিনের ভাড়াও। বর্তমানে হাসপাতালের প্রতিদিনের কেবিন ভাড়া ৩ হাজার টাকা রাখা হয়। এরপর সেই ভাড়ার ওপর রয়েছে ১৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ। এ ছাড়া রোগীর হাতে স্যালাইন কিংবা ইনজেকশন দেওয়ার জন্য ক্যানোলা লাগানোর ফি নেওয়া হয় ১০০ টাকা।

জানা গেছে, ১৯৭৯ সালে আগ্রাবাদে পরিত্যক্ত একটি ভবনে শুরু হয় মা ও শিশু হাসপাতালের কার্যক্রম। ৪৪ বছরে এই হাসপাতালের পরিধি বেড়েছে কয়েকগুণ। বর্তমানে ১২ তলা ভবনের হাসপাতালে প্রতিদিন বহির্বিভাগে গড়ে দেড় হাজারেরও বেশি এবং আন্তঃবিভাগে ৬৫০-এর বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। ৩ বছর পর পর আজীবন সদস্যদের ভোটে পরিচালনা পরিষদ নির্বাচিত হয়। সেই পরিষদই হাসপাতাল পরিচালনা করে।

বর্তমান পরিষদের সভাপতি প্রফেসর ডা. এমএ তাহের খান ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম আজাদ। চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. নুরুল হক রোগী ভোগান্তির বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘হাসপাতালের কার্যক্রম নতুন ভবনে স্থানান্তর হওয়ার পর ভোগান্তি কিছুটা বেড়েছে। কীভাবে এই ভোগান্তি কমানো যায় সে বিষয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। সেবা কার্যক্রম পরিচালনায় খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেড ভাড়াসহ বিভিন্ন সেবা ফি বাড়ানো হয়েছে। আগামীতে তা আরও বাড়বে।’

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)