বাতিঘরঃচায়না ব্যানার্জী- লেখক অভিজিৎ বসু

অভিজিৎ বসু:
স্বপ্নবান মানুষেরা, স্বপ্ন দেখাতে যারা হেঁটে চলে কুয়াশা মোড়া রাস্তায়। আমাদের এই সিস্টেমে তারাই সবচেয়ে অবহেলিত। আর অন্যরা পদে পদে ডমিনেন্ট করে তাদের। তবে কেউ কেউ চিরচেনা রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় এগিয়ে চলে। আর সেই পথ দিয়ে সাথে নিয়ে চলে আলোর সমুদ্র। যতটুকু সীমাবদ্ধ সম্পদ আর দক্ষতা সবটুকু কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে নির্মাণ করে রঙের বাগান। যেখানে হাসি আর খেলার ছলে এগুতে থাকবে পড়াশোনা। ফিনল্যান্ড, ডেনমার্কে পড়াশোনার আগে শেখানো হয় কতটুকু আনন্দ পাচ্ছে তারা।

স্বপ্নযাত্রীর নাম চায়না ব্যানার্জী। ২০০৩ সালে ফিংড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরিতে প্রথম যোগদান। তখন সেই স্কুল থেকে বৃত্তিও পায়নি। শতভাগ পাশও ছিল না। তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে ভর্তি করার জন্য বলতে থাকেন। অভিভাবকদের সাথে নিবিড় এক যোগাযোগ গড়ে তোলেন। তাদের সাথে নিয়মিত বসতেন, কথা বলতেন, আর তার ফলও পাওয়া গেল সে বছর সমাপনিতে শতভাগ পাশ আর দুইজন স্টুডেন্ট বৃত্তি পেল।

 

২০০৩ সালের শেষের দিকে সরকার পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তখন ছাত্র-ছাত্রী ছিল ৭৫ জন। অক্লান্ত চেষ্টা করতে থাকেন। মা-সমাবেশ, উঠোন বৈঠক, শিশু জরিপ আর যারা দুর্বল তাদেরকে ফ্রি পড়ানো। তারপরই পৌরসভার মধ্যে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট আর স্টুডেন্ট সংখ্যা ২৮৫ জন হয়ে যায়।

২০১১ সালে সিলভার জুবিলী মডেল স্কুলে যোগদান করেন। তখন গড়িয়ে গড়িয়ে চলছিল স্কুল। আর চায়না ব্যানার্জীর নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় শতভাগ পাশ করে সমাপনিতে, অ+ আসে সে বছর।

২০১২ সাল থেকে প্রতিদিন বিকেলে ২ ঘণ্টা ফ্রি পড়ানো শুরু হলো। ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত। যারা দুর্বল তাদের জন্য। আর এতে অন্যান্য শিক্ষকরাও যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। আর সে বছর উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করে সিলভার জুবিলী মডেল স্কুল।

(২০১২-২০১৯) সালে সমাপনি পরীক্ষায় সাতক্ষীরা সদরের সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করে। ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ সালে জেলার মধ্যে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করে স্কুলটি। ২০১২-২০১৯ সাল পর্যন্ত শুধু লেখাপড়া না পাশাপাশি চলতে থাকে বুদ্ধি বৃত্তিক উন্নয়নের কার্যক্রম। আবৃত্তি, নাচ, উপস্থিত বক্তৃতা, ছবি আঁকা, অভিনয়ের তালিম। স্কুলের শিক্ষক ছাড়াও বাইরে থেকে দক্ষ শিক্ষক নিয়ে এসে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। আলোকিত হতে থাকে ছাত্র-ছাত্রীরা।

চায়না ব্যানার্জী ২০১৫ সালে খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে সিলভার জুবিলী মডেল স্কুল খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ স্কুল নির্বাচিত হয়।

এই স্কুল থেকে প্রতি বছর ছাপানোর একটি পত্রিকা ‘সন্ধিক্ষণে’ বের হয়। আছে বন্ধুফান্ড, সেখান থেকে খাতা, কলম, বই, জামা-কাপড়, দুস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের সরবরাহ করা হয়। আর বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী যারা স্বচ্ছল তারাই এর ফান্ড যোগায়।

সবাই নেতৃত্ব দিতে পারে না। চায়না ব্যানার্জী পরিকল্পনা করতে থাকেন কীভাবে স্কুলটিকে আরো ভালো করা যায়। শহরের বেশ কিছু মানুষের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে স্থাপন করা হলো মনিটর, সিসি ক্যামেরা, সাউন্ড বক্স। অনেক স্কুলে কাগজে কলমে ব্যাপারগুলো থাকলেও এখানে সবকিছুর অস্তিত্ব আছে সেটা বড় ব্যাপার। ছাত্র-ছাত্রীদের সঞ্চয় মনোভাব আনার জন্য স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম খোলা হয়। মহানুভবতার দেয়াল, সততা স্টোর। সমস্ত দেয়াল জুড়ে ঐতিহ্যের ছাপ। ঢেঁকি, চরকা, গরুর গাড়ির চলা। ফেলে আসা সময়কে ছোখের সামনে থেকে দেখে একটু থমকে দাঁড়ানো। স্কুলে লাইব্রেরী আছে আর তাতে তিন হাজার বইয়ের জগৎ। মনগুলো এলোমেলো করে দেবার মতো ব্যাপার। রাসেল কর্ণার, হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু কর্ণার, মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার, সাফল্যের কর্ণার, যেখানে সদ্য মহিলা সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ান ক্যাপ্টেন সাবিনা খাতুন, নাট্যাভিনেতা তারেক আনাম, বর্তমান এমপির ছবি। ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, সাংস্কৃতিক ক্লাব, ক্রীড়া ক্লাব আছে।

 

শিশুদের মনের মতো করে সাজানো হয়েছে প্রতিটি কথা। বাতাসে দোল খাচ্ছে ফুল, ছাদে গড়ে তোলা হয়েছে বাগান, ক্ষুদে ডাক্তারের টিম। দুর্যোগকালীন একটা টিম আছে। নতুন বিল্ডিং হয়েছে। ওয়াশ রুমের ব্যবস্থা, হাত ধোঁয়ার জন্য দুটো বড় বেসিন। ছাত্র-ছাত্রীরা আনন্দে দোলনায় খেলছে। স্লিপার বেয়ে নেমে আসছে নিচে।

আর এসবের জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয় সম্মেলনে ২০১৬ সালে খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৮ সালে খুলনা বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে জেলা প্রধান শিক্ষক সমিতির আহবায়ক। শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সেক্রেটারি ছিলেন ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত স্বজন সদস্য টি.আই.বি. সাতক্ষীরা।

আচ্ছা এতো কাজ কখন করেন?

চুপচাপ থাকেন চায়না ব্যানার্জী। মেপে মেপে কথা বলেন, খুব জোরে বলেন না। মনের মধ্যে হয়তো বিনির্মাণ করছেন কোনো স্বপ্ন। যেখানে অসংখ্য রঙ খেলে যায়। বুঝতে পারি আরো অন্যরকম ভাবে সাজাতে চান। পুরো সিস্টেমটা বদল করতে চান। ৬ দিনের ২০১৬ সালে হ্যানয়, ভিয়েতনামে Knowledge Based Learning and Knowledge Based Teaching কথা মনে আসছে হয়তো।

ছাত্র-ছাত্রীদের বললে চোখে খেলে যায় সূর্যের ঝিলিক। ভাবতে থাকি প্রতিটি স্কুলে একজন করে চায়না ব্যানার্জী থাকলে বিশাল বাতাস আঘাত আনতো আমাদের প্রথাগত ইঁদুর দৌড় সিস্টেমে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)