কালিগঞ্জে রতনপুরের খালে বাঁধ দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক :
কালিগঞ্জের রতনপুরের খালে বাঁধ দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে একটি খাল খোর চক্রের বিরুদ্ধে। কালিগঞ্জ কাকশিয়ালি নদী হতে প্রবহমান শাখা খালগুলোর মধ্যে মথুরেশপুর ইউনিয়ন হয়ে উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের মহেশকুড় গ্রাম হইতে গড়ুইমহাল, গোয়ালপোতা, শিববাড়ি, মাদকাটি, আড়মগাছা হয়ে খড়মি পর্যন্ত একটি প্রবহমান শাখা খাল অবস্থিত। উল্লেখিত অঞ্চলগুলোর হাজার হাজার বিঘা ঘেরের ও ফসলি জমির পানি নিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে খালটি।

কিন্তু একটি প্রভাবশালী মহল প্রবহমান খালের মহেশকুড় ব্রিজের সামনে একটি বেড়িবাঁধের মাধ্যমে পানি প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে রেখেছেন। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই এলাকাগুলো বন্যায় কবলিত হয়ে পড়ে।

বাঁধ দেওয়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, এলাকার অধিকাংশ মানুষই মাছ চাষের উপর নির্ভরশীল। শুকনা মৌসুমে ঘেরে পানির প্রয়োজন হয় এবং চাষিরা উল্লেখিত খাল থেকে সেচ মেশিনের মাধ্যমে ঘেরে পানি ভরেন। এটাকেই পুঁজি করে প্রভাবশালী একটি মহল চাঁদাবাজিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। মহলটি প্রবহমান খালের মহেশকুড় ব্রিজের প্রান্তে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে এবং অপর প্রান্ত খড়মির সুইচ-গেট দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের নদী হতে লোনা পানি প্রবেশ করায়। ফলে খালে উপচে পড়া একটি লোনা পানির জোয়ারের সৃষ্টি হয় এবং খালের দুই পাশে অবস্থিত সকল মৎস্য ঘের লোনা পানিতে পরিপূর্ণ হয়।

ঘেরে লোনা পানির জোয়ার দেয়ায় চক্রটি মাছ চাষিদের নিকট হতে বিঘা প্রতি তিনশত হতে পাঁচশত টাকা করে চাঁদা আদায় করে। এভাবে চক্রটি চাঁদাবাজির মাধ্যমে প্রতিবছর হাজার হাজার বিঘা জমি থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

এদিকে খালের লোনা পানির প্রভাবে আশেপাশের কোন জমিতেই ধান বা অন্য কোন ফসল হচ্ছে না। কিন্তু চক্রটির ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পান না।

চক্রটি সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, কালিগঞ্জ উপজেলার ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় এই চক্রটি তাদের চাঁদাবাজি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে চক্রে বেশ কিছু সদস্যের নাম উঠে আসে। অন্যতম সদস্যদের মধ্যে আছে, গোয়ালপোতা গ্রামের মৃত : গফুর সরদারের ছেলে মুনসুর সরদার (সাবেক ইউপি সদস্য ও জামায়াত নেতা,৩ নং ওয়ার্ড,রতনপুর ইউপি) , মৃত: মুনসুর আলী মাস্টারের ছেলে মো: মুন্না (১,২ ও ৩ নং ওয়ার্ড মহিলা মেম্বরের স্বামী, রতনপুর ইউপি), মৃত: আব্দুল গফফারের ছেলে মো: বাবু (ইউপি সদস্য, ৩ নং ওয়ার্ড, রতনপুর ইউপি), নৈহাটি গ্রামের আহম্মদ আলী পটোর ছেলে আফছার আলী, গড়ুইমহল গ্রামের মৃত: হযরত আলী গাজীর ছেলে আবু জাফর ও মৃত : মোখসেদুর রহমানের ছেলে সাইফুল ইসলাম (ইউপি সদস্য ২ নং ওয়ার্ড, রতনপুর ইউপি) সহ আরো অনেকে।

এদের মধ্যে মুনসুর সরদার,মুন্না ও বাবু মেম্বর উপজেলার প্রভাবশালী নেতা সহ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্টদের অনৈতিক ভাবে ম্যানেজ করে খালে লোনা পানি প্রবেশ করানোর কাজটি করে থাকেন ।

অন্য সদস্য সাইফুল মেম্বর ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে খালের একটি অংশ দখল করে মাছ চাষ করেন। বাকি সদস্যদের মধ্যে আবু জাফর ও আফছার আলী মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন। তারা দুইজন ঘের মালিকদের নিকট হতে বিঘা প্রতি তিনশত হতে পাঁচশত টাকা চাঁদা আদায় এবং বাঁধ দেখভাল করেন।

এরপর চাঁদাবাজির আদায়কৃত টাকা চলে যায় প্রধান তিন সদস্য মুনসুর সরদার, মুন্না ও বাবু মেম্বরের হাতে। চাঁদাবাজির এই টাকা নিজেদের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা হয় এবং একটি অংশ যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের এস.ও এর হাতে, একটি অংশ যায় গেট খালাসির হাতে ও একটি অংশ যায় উপজেলার প্রভাবশালী নেতাদের পকেটে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাদের এক সদস্য।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চক্রের অন্য এক সদস্য বলেন,”উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদীর মাধ্যমেই খালে লোনা পানি ঢুকানো হয়।চলতি বছরে গেট খালাসি, এসও এবং সবাইকে দিয়ে কয়েক লক্ষ টাকা অলরেডি খরচ হয়ে গেছে। এদিকে অনেক ঘের মালিক এখনো টাকা দেননি।”
উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী কে টাকা দিতে হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে এই সদস্য বলেন,”উনাকে টাকা তো অবশ্যই দিতে হয়, তা না দিলে চলবে…!”

এদিকে সম্প্রতি খাল দখলমুক্ত করার নিমিত্তে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর একাধিক দরখাস্ত প্রদান করা হয়েছে বলে জানান এক ভুক্তভোগী।
দরখাস্তকারী ভুক্তভোগী বলেন,”খালটির মহেশকুড় প্রান্তের বাঁধের কারণে, খালের লোনা পানির চাপে বাঁধের পাশে অবস্থিত আমার পুকুরের পাড় ভেঙ্গে এক পাশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে অন্য পাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে আমার পুকুরের এক লক্ষ টাকার মাছ ভেসে গেছে।

তাছাড়া পুকুরের পাড়ে অবস্থিত নারিকেল গাছ, খেজুরগাছ সহ বিভিন্ন প্রকার গাছ ভেসে গেছে। বাঁধের কারণে প্রতিবছরই আমার এই ধরনের ক্ষতি হয়। এজন্য আমি গত ইংরেজি ১৪-০৮-২০২২ তারিখে খাল অবমুক্ত করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট আবেদন করেছি, যেটির ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপজেলা ভূমি অফিসকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আজও কোন ব্যবস্থা নেননি।”

একইভাবে খাল উন্মুক্ত করার নিমিত্তে আরেক দরখাস্তকারী বলেন,”সরকারি খাল দখল করে মাছ চাষ করছে গড়ুইমহাল এলাকার ২ নং ওয়ার্ডের মেম্বর সাইফুল ইসলাম। এতে সরকারি ইট সোলিং রাস্তার ক্ষতি হচ্ছে এবং আমার বসবাসের অসুবিধা হচ্ছে। সরকারি খাল অবমুক্ত করার জন্য আমি গত ২৬-০৫-২০২২ তারিখে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর দরখাস্ত করি। এর জেরে গত ১৯-০৬-২০২২ তারিখে বিভিন্ন পত্রিকায় “কালিগঞ্জের রতনপুরে খাল দখলের অভিযোগ ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে : ঝুঁকিতে সরকারি রাস্তা ও প্রবাসীর বসতবাড়ি” শিরোনামের সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু আজও খালটি অবমুক্ত করা হলো না।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঘের মালিক জানান,”খালের লোনা পানির জন্য প্রতিবছর এই চক্রের সদস্য জাফর ও আফসার বিঘা প্রতি আমার কাছ থেকে তিনশত করে টাকা নেয়। টাকা না দিলে এখানে ঘের করা যাবে না। অথচ লোনা পানির জন্য কোন প্রকার ধান হয় না ও বাঁধের জন্য বন্যা হয়ে মাছ ভেসে যায়। আমরা এই চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে আছি।”

এবিষয়ে খাল খোর চক্রটির সদস্য মুন্না বলেন, খালে পানি আনতে বিভিন্ন দপ্তরে ও নেতাদের টাকা দিতে হয়, ঘের করা লাগে এজন্য টাকা উঠায়। আমাদের পকেটে কিছুই থাকে না।

এদিকে খাল খোর চক্রের অন্যতম সদস্য বাবু মেম্বর এই প্রতিবেদককে মোবাইল ফোনে সংবাদ প্রকাশ নাকরতে বিভিন্ন হুমকি দেন।

উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদীর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি খাল উন্মুক্ত করে বেড়াই এজন্য মামলাও খেয়েছি , কারো কাছ থেকে টাকা নেই না।

এ সম্পর্কে কালীগঞ্জ উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও তন্ময় হালদার জানান, আমি তাদের চিনি না। টাকা নিবো কিভাবে ? এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা এধরনের কোন লেনদেন হয় না আমাদের সাথে।

চাঁদাবাজির বিষয়ে ১১ নং রতনপুর ইউপি চেয়ারম্যান আলিম আল রাজি টোকন জানান, আমি প্রথম থেকে খাল দখল কারিদের বিপক্ষে, এরমধ্যে আমি কয়েকটি খাল উন্মুক্ত করেছি, যার জন্য আমাকে কাফনের কাপড় পর্যন্ত পাঠানো হয়েছে। এবিষয়ে কোন অভিযোগ পেলে আমি অবশ্যই ব্যবস্থা নিব।

বিষয়টি সম্পর্কে কালীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ রোকনুজ্জামানের ব্যবহিত মোবাইল নম্বরে গত এক সপ্তাহের বেশি বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এবিষয়ে ১১নং রতনপুর ইউনিয়নের নায়েব মোশারফ হোসেন বলেন, আমরা খালটির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি, দ্রুত ব্যবস্থা নিব।

অন্যদিকে এই চাঁদাবাজ,দখলদার ও খাল খোরদের কবল থেকে প্রবহমান খালটি উন্মুক্ত করলে মাছ চাষ ও ধান চাষে আগের সুদিন ফিরে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট চাষিরা। এজন্য খাল উন্মুক্ত করাসহ চাঁদাবাজি বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)