খৈতলা সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে চোরাকারবারির মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের মামলা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা :

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খৈতলা সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে কুশখালি মক্তব মোড়ের চোরাকারবারি হাসানুর ওরফে মা›রুলির মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। সদর থানার উপপরিদর্শক সেকেন্দার আলী বাদি হয়ে কারো নাম উলে­খ না করে মঙ্গলবার এ মামলা দায়ের করেন।
এদিকে কুশখালি মক্তব মোড়ের চোরাকারবারি রিয়াজুল ইসলামকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার এক মাস সাত দিনেও কোন ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। অভিযোগ, সাধারণ ডায়েরীর পর পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আটক করার পর আর্থিক সুবিধা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
নিখোঁজ হওয়া রিয়াজুলেল বাবার নাম আনছার আলী।

সরেজমিনে মঙ্গলবার সকালে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কুশখালি মক্তব মোড়ে গত রবিবার খৈতলা সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে নিহত শেখ হাসানুর রহমানের বাড়িতে যেয়ে দেখা গেছে মা অমেত্বভান ও বড় বোন ফতেমা পাগলের প্রলাপ বকছে। ছোট বোন পাগল আমেনা ৮ মাসের ভাইপো রিফাত আমিনকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

জানতে চাইলে অমেত্বভান জানান, তারি বাবা তকিম মোল­ার অভাবের সংসার ছিল। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মুড়োগাছা গ্রামের শেখ হায়দার আলী ৩০/৩৫ বছর আগে তাদের পাড়ায় এসে ভারতীয় চিনি পাচার করতো। ৩০ বছর আগে হায়দার আলীর সঙ্গে তার বিয়ে দেন বাবা। দু’ ছেলে ও দু’ মেয়ের জন্ম হওয়ার পর হায়দার তাদেরকে বাপের বাড়িতে ফেলে মুড়োগাছায় যেয়ে আবারো বিয়ে করে। চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে প্রতিবন্দি আল আমিন নয় বছল আগে মারা যায়। বড় মেয়ে ফাতমার বিয়ে হয় রেউই গ্রামের ইসমাইলের সাথে। তালাক দেওয়ায় এক ছেলেকে নিয়ে ফাতেমার আশ্রয় হয় বাপের বাড়িতে । ছেলে ওসমানকে রেখে ফাতেমা ঢাকায় পোষাক কারখানায় কাজ করে।

হাসানুরের বিরুেেদ্ধ পাঁচরকির একটি হত্যা মামলা ছাড়াও আরো চারটি মাদকের মামলা হওয়ায় আদালত খরচ মেটাতেই হাসানুরকে হিমসিম খেতে হতো। হাসানুর বছর দুইয়েক আগে বিয়ে করলেও সংসার চালাতে পাগল প্রায় মেয়ে আমেনাকে নিয়ে তিনি মক্তবমোড়ে হাটবারে ভিক্ষা করেন। শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর রাতে সে বাড়ি ফেরেনি। একপর্যায়ে খৈতলা সীমান্তের ৯ নং মেইন পিলারের এক নং সাব পিলারের পাশে শূন্য রেখায় বিএসএফ তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালালে খবর পেয়ে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে তাকে দেখতে যান। সকাড়ে সাড়ে সাতটার দিকে খুলনায় নিয়ে যাওয়ার পথে সে মারা যায়। কমবয়সী পুত্রবধু ও আট মাসের পৌত্র, এক পাগল মেয়েকে নিয়ে তিনি কিভাবে দিন কাটাবেন তা নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সমিরি ঋণ রয়েছে তাদের। মামলা করবেন না এমনটি জোর দিয়ে তিনি বলেন, মামলা করে কি হবে! বিচার পাবকি? বিচারের ভার সৃষ্টিকর্তার কাছে সপে দিলাম।

তবে নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে হাসানুরের এক নিকট বন্ধু জানান, প্রতিবেশি শাহজাহান আলীর ছেলে আরিফুল ও মিত্তাব মোল­ার ছেলে আকি শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে বাড়ি থেকে যেেেক নিয়ে যায়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে কালিয়ানি ছয়ঘরিয়া এলাকার বেড়িবাঁধে তাদের সঙ্গে আরো তিনজন যোগ দেয়। একসাথে তারা ভারত থেকে মাদক নিয়ে ফেরার সময় ভোর সোয়া তিনটার দিকে দুবলী বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এতে হাসানুরের পিঠে গুলি লাগে। পেট দিয়ে ওই গুলি বের হয়ে যায়। তার সঙ্গে থাকা সহযোগীরা খৈতলা থেকে তাকে তুলে নিয়ে স্বজনদের মধ্যেমে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।

তবে হাসানুর কুশখালি ইউপি’র তিন নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কুশখালির আতিয়ার ঢালীর ছেলে আমানুল­াহর জন্য মাদক আনতে গিয়েছিল বলে দাবি করেন ওই বন্ধু। মুখ খুললে আরো বিপদহতে পারে তাই পরিবারের লোক মুখ খুলছে না।
বৈকারী বিওপি’র নায়েক সুবেদার আবু তাহের জানান, রবিবার বিকেল সাড়ে তিনটায় বিএসএফ ও বিজিবি’র ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে কৈজুড়ি বিএসএফ ক্যাম্পের শূন্য রেখা বরাবর পতাকা বৈঠক হয়। বৈঠকে বিএসএফ এর পক্ষে ১৫৩ বিএসএফ কমানডেন্ট মনিশ নেগি ও সাতক্ষীরা বিজিবি’র ৩৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল আল মাহমুদ প্রতিনিধিত্ব করেন। বৈঠকে বিএসএফ এর পক্ষ থেকে গুলির কথা অস্বীকার করা হয়।
তবে হাসানুরের পিঠে লাগা গুলি পেট দিয়ে যেভাবে বড় গর্ত করে বের হয়ে গেছে তা বিএসএফ এর এসএলআর এর গুলি বলে প্রতীয়মান হয় বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজিবি কর্মকর্তা।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান জানান, নিহত হাসানুরের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করায় সদর থানার উপপরিদর্শক সেকেন্দার আলী বাদি হয়ে কারো নাম উলে­খ না করে মঙ্গলবার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
সকাল ১১টার দিকে নিহত হাসানুরের প্রতিবেশি আনছার আলীর বাড়িতে গেলে তিনি জানান, তার ছোট ছেলে রিয়াজুল এক সময় খুলনায় একটি ভাটায় কাজ করলেও স্ত্রী পাপিয়া তাকে তালাক দেওয়ায় বাড়িতেই থাকতো। এ সময় তার ছেলে রিয়াজুল(২৫) ও হাসানুর একই সাথে ভারতীয় মাদক, পশু ও পাখি আনার বাহক হিসেবে কাজ করতো। তিন মাস আগে বিরোধের কারণে হাসানুরের সঙ্গে রিয়াজুলের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।

পহেলা সেপ্টেম্বর কুশখালি ঢালীপাড়ার আতিয়ার ঢালীর ছেলে তিন নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আমানুল­াহ চোরাচালনী ঘাট খৈতলায় যেয়ে রিয়াজুল ও তাদের আত্মীয় শিকড়ি গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে জহুরুলের কাছে পুলিশকে মাদক ব্যবসার খবর দেওয়ার অভিযোগে মারপিট করে। বিষয়টি নিয়ে পরদিন মক্তব মোড়ের তোতার দোকানে শালিসী বৈঠকে আমানুল­াহ ক্ষমা চাইলেও রিয়াজুলকে খুন করার হুমকি দেয়। এর দুই দিন না যেতেই আমানুল­াহ ইচ্ছায় রিয়াজুলকে বাড়ি থেকে কুশখালি ছয়ঘরিয়ার গোলাম হোসেনের ছেলে জাহিদ ও কুশখালি পশ্চিমপাড়ার আশরাফুলের ছেলে রাজু ডেকে নিয়ে লাপাত্তা করা হয়েছে।

১০ সেপ্টেম্বর থানায় ৫৯৪ নং সাধারণ ডায়েরী করার পরপরই উপরিদর্শক শাহাজালাল ছয়ঘরিয়ার গ্রামের খায়রুল. সাগর ও রিয়াজউদ্দিন ঢালীর ছেলে মিন্টুকে ধরে নিয়ে মোটা অংকের টাকা নিয়ে প্রথমাক্ত দুইজনকে ছেড়ে দেয়। টাকা দিতে না পারায় মিন্টুকে ৫৪ ধরায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়। কয়েকদিন আগে ছয়ঘরিয়ার আমিনুরে মোল­ার চেলে মাদক পাচারকারি রুবেল পথে তাকে (আনছার) ও স্ত্রী আছিয়া খাতুনকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। তার ছেলে নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে আমানুল­াহ, রুবেল, ছয়ঘরিয়ার মোজাম ঢালীর ছেলে জাহাঙ্গীর ও একই এলাকার জফের মোল­ার চেলে শিমুল, ছাত্দার মোল­ার ছেলে খায়রুল , শহীদুলের চেলে আলমগীর, রাজু, বাবু মোল­ার ছেলে সোহাগ ও জাহাঙ্গীরের ছেলে সাগর, মাসিদ ঢালীর ছেলে তৌহিদ জড়িত বলে তিনি মনে করেন। বার বার থানায় যাওয়ার পরও পুলিশ মামলা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এ ব্যাপারে কুশখালি ইউপি’র তিন নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আমানুল­াহ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আওয়ামী লীগের বদনাম করার জন্য একটি মহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তার সম্পর্কে জানতে তিনি আওয়ামী লীগ মনেতা ভিপি মোর্শেদ ও কুশখালি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির কাছে যোগাযোগ করতে বলেন।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর থানার উপপরিদর্শক শাহাজালাল এর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টায় মুঠো ফোন রিসিভ করেননি সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল কাইয়ুম ।

এ ব্যাপারে বৈকারী বিজিবি ক্যাম্পের নায়েব সুবেদার আবু তাহের ও কুশখালি বিওপি ক্যাম্পের নায়েব সুবেদার শামীম আলম বলেন, রিয়াজুল নিখোঁজের ব্যাপারে তাদের কাছে কোন অভিযোগ করা হয়নি। তবে মানব পাচার শূন্যের কোটায় দাবি করে তারা বলেন, সীমান্তে সড়কের মান ভাল না হওয়া, উন্নত মানের গাড়ি না থাকা ও জনবল সঙ্কটের কারণে পাচার পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া সীমান্ত গ্রামবাসি পাচার সম্পর্কে সচেতনা না হওয়া বা বিজিবি’র নজর এড়িয়ে পাচার কাজে জড়িয়ে পড়ায় একেবারে বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)