কালিগঞ্জের বড়শিমলা কারবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪০ লাখ টাকা নিয়োগ বাণিজ্য

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা :

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার ভাড়াসিমলা ইউনিয়নের বড়শিমলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষকসহ পাঁচজনকে দুই দফায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ২৪ জুন ও ২ সেপ্টেম্বর সুবিধাজনক নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষা চুড়ান্তের মাধ্যমে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ সংশ্লিষ্টরা অনিয়ম ও দূর্ণীতির মাধ্যমে ৪০ লাখ টাকার বেশি নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন মর্মে অভিযোগ উঠেছে।

কালিগঞ্জের বড়শিমলা কারবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে এ বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। বিদ্যালয়টি স্থাপনের পর থেকে যোগ্য শিক্ষকমণ্ডলীর মাধ্যমে সুনামের সঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রম চলে আসছিল। উকসা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কম্পিউিটর শিক্ষক গাজী মিজানুর রহমান ২০১৭ সালে বড়সিমলা কারবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। যোগদানের দুই দিন পর তার বিরুদ্ধে কালিগঞ্জ হাসপাতাল সড়কে কারবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে স্থানীয়রা মানববন্ধন করেন।

মানববন্ধন চলাকালে ২০১৬ সালে নিজের ছাত্রী নবম শ্রেণীর এক হিন্দু শিক্ষার্থীকে ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে অন্তঃস্বত্বা হয়ে পড়ায় নিজেকে বাঁচাতে ওই মেয়ের বাবাকে ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা দিয়ে মেয়েকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া ও ২০১৭ সালে নাশকতা মামলায় ১৭ দিন জেল হাজতে থাকা গাজী মিজানুর রহমানকে বয়কট করতে হবে মর্মে স্লোগান দেওয়া হয়।

সূত্রটি আরো জানায়, মিজানুর রহমান নিজেকে নিরাপদে রাখতে অধিকাংশ অনেকের অগোচরে কালিগঞ্জের বহুল আলোচিত উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাঈদ মেহেদীকে এক বছরের জন্য বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির আহবায়ক মনোনীত করেন। পরবর্তীতে নিয়োগ বাণিজ্যের কথা মাথায় রেখে অনিয়ম ও দূর্ণীতির মাধ্যমে সাঈদ মেহেদীকে সভাপতি করে পকেট কমিটি গঠণ করা হয়।

সূত্রটি জানায়,চলতি বছরের ৭ এপ্রিল বড়শিমলা কারাবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষক, অফিস সহকারি ও আয়া পদে নিয়োগের জন্য একটি স্থানীয় ও একটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সহকারি প্রধান শিক্ষকপদে তিনিসহ অনাথবন্ধু রায় ওরফে টাইগার, দীপঙ্কর রায়, দীপঙ্কর ঘোষসহ কয়েকজন আবেদন করেন। যথাসময়ে আবেদনকারিদের কোরাম পূর্ণ হলেও পরবর্তীতে আবারো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় একই পত্রিকায়। এ বিজ্ঞপ্তির পর প্রধান শিক্ষককের মামাতো বোন রতনপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক লবনজ পারভিন সহকারি প্রধান শিক্ষক পদে আবেদন করেন।

২৪ জুন নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষকও অফিস সহকারি পদে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। তবে কোরাম পূর্ণ না হওয়ায় আয়া পদে পরীক্ষা গৃহীত হয়নি। সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে লবণজ পারভিন, অফিস সহকারি হিসেবে মধ্য ভাড়া শিমলার মারুফ হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ল্যাব সহকারি, নিরাপত্তা প্রহরী ও আয়া পদে গত ২ সেপ্টেম্বর নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ল্যাব সহকারি পদে উচ্চ মাধ্যমিক পাস নাজমুন্নাহার, নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে এজাজ আহম্মেদ ও আয়া পদে আনোয়ারা খাতুনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এসব নিয়োগে যোগ্যদের বাদ দিয়ে স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির বিরুদ্ধে।

কালিগঞ্জের নলতা বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রধান শিক্ষককের মামাতো বোন রতনপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক লবনজ পারভিনকে নিয়োগ দিতে প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে কোরাম পূর্ণ হওয়ার পরও দ্বিতীয়বার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এতে অনিয়ম ও দূর্র্ণীতি করা হয়েছে।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বড়শিমলা কারবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ সহকারি প্রধান শিক্ষক পেতে তিনি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ইংরেজিতে করার জন্য মত পোষন করেছিলেন। তার সঙ্গে অনেকেই সহমত পোষণ করলেও সভাপতির আপত্তিতে বাংলায় প্রশ্নপত্র করা হয়। প্রশ্নপত্রে একটি অংক এক্স প্লাস ওয়ান বাই এক্স = ৪ হলে এ স্কোয়ার প্লাস ওয়ান বাই এ স্কোয়ার এর মান কত? উলে­খ করলে পরবর্তীতে ভুল প্রশ্নপত্র ও পরীক্ষার্থীরা তা কাটাকাটি করে সংশোধন করে নেন। সভাপতির কথামত ইংরেজিতে প্যারাগ্রাফ এসডিজি (সাসটেনেবল ডেভলপমেন্ট গোল্ড) প্রশ্নপত্রে রেখে তা লবণজ পারভিনকে আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এ নিয়োগে ১২ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ করেন ওই সদস্যসহ কয়েকজন পরীক্ষার্থী।

উপরোক্ত সদস্য বলেন, যুব উন্নয়ণ থেকে ন্যাশনাল সার্ভিসে তার আত্মীয় খারহাট গ্রামের মিঠুন দাস চার বছর কারবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে ২০২০ সালে করোনাকালিন সময়ে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিদ্যালয়ের সংস্কার কাজ দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। বলা হয় মেয়াদ শেষে কিছু টাকা দেওয়ার। কিন্তু প্রধান শিক্ষক কোন টাকা না দিয়েই ঠিকাদারের সঙ্গে সমঝোতা করে ত্র“টিপূর্ণ কাজ যথাযথ হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন দিয়ে বরাদ্দের মোটা টাকা পকেটস্ত করেছেন। ২৪ জুলাই মিঠুন দাস, মৃত্যুঞ্জয় ঘোষসহ ৫জন অফিস সহকারি হিসেবে পরীক্ষা দিয়েছেন। নিয়োগ পরীক্ষার আগের রাতে পুরাতন কর্মী হিসেবে মিঠুনকে নেওয়া হবে মর্মে বিশেষ কসম খান প্রধান শিক্ষক। এরপরও ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে মারুফকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

ভাড়াসিমলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের চার নং ওয়ার্ডের সভাপতি মিন্টু ঘোষ জানান, ল্যাব সহকারি পদে তার ছেলে অনার্স মাষ্টার্স পাশ রাহুল ঘোষকে নিয়োগ দেওয়ার নামে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনের মাধ্যমে সভাপতি সাঈদ মেহেদীকে তিন লাখ টাকা দেন তিনি। নিয়োগের দিন সাত লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। ওই দিন রাহুলকে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে ১০ লাখের ও বেশি টাকার বিনিময়ে নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী নওশের আলীর মেয়ে এইচএসসি পাস নাজমুন্নাহারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ পরীক্ষায় ইয়াছির আরাফাত সম্রাটসহ আরো কয়েকজন অংশ নেন।

নৈশপ্রহরী পদে শেখ মিলন হোসেন, এজাজ আহম্মেদ, স্বরুপ কুমারসহ কয়েকজন পরীক্ষা দিলেও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের লোক বলে পরিচিত হওয়ায় সাত লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পেয়েছেন এজাজ আহম্মেদ। তবে প্রবেশপত্র পাওয়ার পরও নিয়োগের আগে প্রার্থী চুড়ান্ত হয়ে গেছে জানতে পেরে পথ খরচ করে কেন্দ্রে যাননি যুবলীগ নেতা শাহাঙ্গীর আলম।

আয়া পদে নিয়োগ পেয়েছেন আনোয়ারা খাতুন। পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন প্রবাসী ফারুক হোসেনের স্ত্রী আরিফিন ও তাজিবরের স্ত্রী নীলুফা। নীলুফাকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক ৫ লাখ টাকা নিয়ে ছিলেন। কিন্তু বেশি টাকা পাওয়ায় ওই টাকা ফেরৎ দিয়ে আনোয়ারাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তাজিবর রহমানের আত্মীয় মুজিবর রহমান।

তবে নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারি প্রধান শিক্ষক লবনজ পারভিন, অফিস সহকারি মারুফ হোসেন, ল্যাব সহকারি নাজমুন্নাহার, নিরাপত্তা রক্ষী এজাজ আহম্মেদ ও আয়া অনোয়ারা খাতুন নিয়োগে টাকা লাগার বিষয়টি অস্বীকার না করলেও তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, এ ধরণের চাকুরি টাকা ছাড়া হয় কিনা তাদের জানা নেই।

তবে এলাকার কয়েকজন সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বলেন, বিদ্যালয়ের নামীয় ১০ কাঠা জমি বর্তমান সাল পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করা হলেও বিদ্যালায়ের শিক্ষানুরাগী ও ইদগাহ কমিটির সভাপতি হিসেবে হাজী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগসাজসে গত বৈশাখ মাসে তিন বছরের জন্য আলাউদ্দিনের কাছে ৭১ হাজার টাকা ইজারা দিয়ে কমিটির মিটিং ডেকে সিদ্ধান্ত ছাড়াই ইদগাহ কর্তৃপক্ষকে ওই টাকা দিয়ে দিয়েছেন সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বড়সিমলা কারবালা মাধ্যমিক বিদালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান বুধবার বিকেল সাড়ে চারটায় নিজেকে সংবাদ কর্মী পরিচয় দিয়ে বলেন,(০১৭২০-৫৮৬৮০৪) নিয়োগ পরীক্ষায় কোন অনিয়ম হয়নি। প্রথমবার প্রতিদ্ব›িদ্ব ছিল না বিধায় কোরাম পূরণ না হওয়ায় দ্বিতীয়বার বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। লবণজ পারভিন আমার দুঃসম্পর্কের মামাত বোন। নিয়োগ পরীক্ষ কোন অর্থিক লেনদেন হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। এ ছাড়া কোন হিন্দু ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।

বড়সিমলা কারবালা মাধ্যমিক বিদালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি সাঈদ মেহেদী বুধবার বিকেল চারটা ২৬ মিনিটে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পূর্ণ ফেয়ার হয়েছে দাবি করে বলেন, প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান একজন খুব ভাল মানুষ। এলাকার ঈদগাহ ও স্কুলের একটি জমি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে বিরোধ চলছে। এই বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষরা স্কুলের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মিথ্যে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এছাড়া আগের কমিটির লোকজন নিয়োগ বাণিজ্য করেছিল। এবার পারেনি তাই তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)