ওপেক আর ইরানের পরমাণু ইস্যুতে দুলছে বিশ্বের তেলের বাজার
আন্তর্জাতিক :
বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো ‘দি অর্গানাইজেশন অব দি পেট্রোলিয়াম কান্ট্রিস’ বা ওপেক নামে পরিচিত। আবার ওপেকের বাইরে থেকে যাওয়া অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশ ও ওপেকের সদস্যদের একত্রে ওপেক প্লাস নামে অভিহিত করা হয়। বিশ্বের জ্বালানি বাজার মূলত এই ওপেক ও ওপেক প্লাস জোটের অঙ্গুলি হেলনে ওঠানামা করে।
সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) তেলের উৎপাদনের পরিমাণ নতুন করে নির্ধারণ করতে ওপেক প্লাস সদস্যরা বৈঠকে বসে। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো উৎপাদন বর্তমান হারেই বজায় রাখবে, না-কি কমাবে, বৈঠক শেষে সে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে।
তবে সোমবার বৈঠকের ব্যাপারে যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনীতি বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিএমসি মার্কেটসের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ টিনা টেং বলেন, করোনা লকডাউনের কারণে চীনের চাহিদা কমে যাওয়ায় মূল্যহ্রাস ঠেকাতে ওপেক তেলের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর হঠাৎ করেই তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। গত মার্চ মাসে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১৩০ ডলারের ওপরে উঠে যায়। এরপর কিছুদিন মূল্য চড়া থাকার পর গত তিন মাস ধরে তেলের দাম কিছুটা কমে আসতে থাকে। আর এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে চীনের করোনা লকডাউন। এখনও করোনা প্রাদুর্ভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি চীন। এ মুহূর্তেও চীনের অন্তত ৩৩ নগরীতে পুরোপুরি কিংবা আংশিক লকডাউন চলছে। যা কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ কোটি মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলছে। এভাবে দফায় দফায় করোনা লকডাউনের কারণে বিশ্বের কারখানা হিসেবে পরিচিত দেশটির শিল্প উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। চীনের চাহিদা কমে যাওয়ায় তেলের দাম আরও পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে ওপেকভুক্ত দেশগুলো। এ পরিস্থিতিতে আগের মূল্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে তারা।
তবে তেলের দাম নির্ধারণে ওপেকের পাশাপাশি ইরানের সঙ্গে পশ্চিমাদের পরমাণু চুক্তি নতুন করে বহাল হওয়ার বিষয়টি নতুন ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন। ইরানের তেল রফতানির ওপর অবরোধ আরোপ করা হয়। তবে পরমাণু ইস্যুতে বর্তমানে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় মধ্যস্থতা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় ইউরোপীয় দেশগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে মস্কো। এ পরিস্থিতিতে নজিরবিহীন জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি ইউরোপীয় দেশগুলো। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশগুলোতে দেখা গেছে মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকট। তাই ইউরোপীয় দেশগুলো বর্তমানে মরিয়া হয়ে রাশিয়ার তেলের বিকল্প সন্ধান করছে। এ পরিস্থিতিতে পরমাণু ইস্যুতে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সমঝোতার সম্ভাবনা তাদের জন্য আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে রফা হলে ইরানের তেল রফতানির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উঠে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ইরানের তেল আমদানিতে আর কোনো বাধার মুখে পড়বে না ইউরোপীয় দেশগুলোকে। এজন্য দুই পক্ষকে রাজি করতে মধ্যস্থতা চালাচ্ছে ইইউ।
বিশ্বের অন্যতম তেল রফতানিকারক ইরানের বিশ্ববাজারে বিপুল পরিমাণে তেল সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে বিশ্ববাজারে প্রতিদিন এক মিলিয়ন ব্যারেলেরও বেশি তেল সরবরাহ করতে পারবে তেহরান।
এ অবস্থায় ইরানের তেল বিশ্ববাজারে ঢোকা শুরু করলে ওপেকভুক্ত দেশগুলো উৎপাদন কমালেও তেলের দামে এর খুব একটা প্রভাব পড়বে না।
এদিকে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁও। গত বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর) তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, পরমাণু ইস্যুতে ইরানের সঙ্গে খুব শিগগিরই ফয়সালা হবে।
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মার্ক কাৎজ বলেন, পরমাণু চুক্তি বহাল হলে ইরানের তেল বিক্রির নতুন সুযোগ তৈরি হবে। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ বেড়ে যাবে, যা দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করবে।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু চুক্তি বাতিল করার আগ পর্যন্ত ইরান ছিল যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও রাশিয়ার পাশাপাশি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ।
ব্রিটেনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা জানিয়েছে, ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে প্রতিদিন গড়ে ১৩ লাখ ব্যারেল তেল বিশ্ববাজারে যোগ করতে পারবে তেহরান। পাশাপাশি এ চুক্তি ইরানের হাতে এ মুহূর্তে জমে থাকা বিপুল পরিমাণ তেল দ্রুত বিশ্ববাজারে সরবরাহের পথও খুলে দেবে। এ মুহূর্তে ইরানের হাতে বিপুল পরিমাণে উত্তোলন করা তেল মজুত অবস্থায় রয়েছে। চুক্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো বিশ্ববাজারে ছাড়তে পারবে ইরান। যা তেলের বর্তমান সংকটকে প্রশমন করতে সহায়তা করবে।
এ ব্যাপারে জেটিডি এনার্জি সার্ভিসেসের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ জন ড্রিসকোল বলেন, ইরানের কাছে তেল সরবরাহের জন্য বিপুল সংখ্যক অয়েল ট্যাংকার রয়েছে। যার সাহায্যে খুব সহজেই বিশ্ববাজারে দ্রুত তেল সরবরাহে সক্ষম তেহরান।
এদিকে তেলের দাম ধরে রাখতে ওপেক প্লাসের তেলের উৎপাদন কমানোর ইঙ্গিত এবং অপরদিকে বিশ্ববাজারে ইরানের তেলের ফিরে আসার সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে গত দুই মাস ধরেই উত্থান-পতনের মধ্যে বিশ্বের তেলের বাজার। এক-দুইদিনের ব্যবধানেই তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০ ডলারের বেশি বেড়ে যাচ্ছে। আবার হঠাৎ করেই কমেও আসছে।
গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৯০ ডলারের নিচে চলে এলেও দুই সপ্তাহের ব্যবধানে গত ২৯ আগস্ট দাম ১০০ ডলারের ওপর উঠে যায়। এরপর আবার মাত্র দুইদিনের ব্যবধানে তেলের দাম ১ সেপ্টেম্বর ৯০ ডলারের নিচে নেমে যায়।
তবে সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) ওপেক প্লাসের বৈঠক সামনে রেখে ফের বাড়তে শুরু করে তেলের দাম। সর্বশেষ অপরিশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক ডব্লিউটিআই ক্রুড প্রতি ব্যারেল ৮৮ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। অপর বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ক্রুড ৯৫ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।