যশোরের ঝিকরগাছায় গদখালিতে  টিউলিপ ফুল চাষে সাফল্যে ফুলচাষিরা

আঃজলিল,যশোরঃ

হিমশীতল দেশ নেদারল্যান্ডসের ফুল টিউলিপ। শীত-গ্রীষ্মের বাধা পেরিয়ে এবার সেই টিউলিপ চাষে সফল হয়েছেন ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীর ফুলচাষি ইসমাইল হোসেন। তার বাগানজুড়ে সেজেছে নানা রঙের বাহারি এই রাজসিক সৌন্দর্যের এই ফুল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ইসমাইলের এই সাফল্যের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো গদখালীতে বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো গরম প্রধান দেশে টিউলিপ ফোটানো এখন পর্যন্ত রীতিমতো সাধনারই বিষয়। অপরিসীম ধৈর্য ধরে সফল হয়েছেন ইসমাইল হোসেন।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম গ্রামের সংবাদকে বলেন, ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীর মাঠগুলোতে এখন শোভা পাচ্ছে রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্র মল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল।
“এবার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে টিউলিপের পরীক্ষামূলক চাষে সাফল্যের মুখ দেখেছে গদখালির একজন ফুলচাষি। এতে ফুল চাষিরা আবারো নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। ফুলের বাজার ছাড়াও স্থানীয় পর্যটন শিল্পের প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে টিউলিপ।”
পরীক্ষমূলক চাষে সফল হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামের ফুলচাষি ইসমাইল হোসেন। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ইসমাইলের বাগানে দোল খেতে শুরু করেছে বাহারি রঙের টিউলিপ। দারুণ এ দৃশ্য দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করছে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষ।
ইসমাইল হোসেন বলেন, নেদারল্যান্ডসের জাতীয় ফুল টিউলিপ। নেদারল্যান্ডস শীত প্রধান দেশ হওয়ায় টিউলিপ ফুলের চাষ এদেশে করতে গেলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ছাউনি তৈরি করতে হয়েছে। পাঁচ শতক জমিতে পরীক্ষামূলক ভাবে ৫হাজার বাল্ব (কন্দ) লাগায়। ৬ জানুয়ারি লাগানো বাল্ব থেকে চারা হওয়ার পর ২০জানুয়ারি তাতে কুড়ি দেখতে পাওয়া যায়।
চাষের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসমাইল বলেন, টিউলিপ শীত প্রধান দেশের ফুল হওয়ায় এদেশে চাষের জায়গাটি প্রথমে সূর্যের তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য শেড নির্মান করতে হবে। এরপর কাট পেঁয়াজের মত টিউলিপ ফুলের বাল্ব মাটিতে সারিবদ্ধ ভাবে লাগাতে হবে। সূর্যের তাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মাটিকে রসালো রাখতে হবে। টিউলিপ ফুলের গাছ ১৭সেন্টিমিটার থেকে ৫০সেন্টিমিটার লম্বা হয়। বাল্ব লাগানোর দু’সপ্তাহের মধ্যে কুঁড়ি আসতে শুরু করে। বিদেশ থেকে বাল্ব আনতেও উল্লেখযোগ্য অঙ্কের শুল্ক লাগে। তাই এব্যাপারে কৃষি অধিদপ্তরকে কৃষকদেরকে সহযোগিতা করতে হবে।
ইসমাইল বলেন, নেদারল্যান্ডস থেকে সংগ্রহ করা টিউলিপ ফুলের বাল্ব(কন্দ) প্রতিটির দাম পড়ে ৭০ টাকা। আর এক একটি টিউলিপ ফুল বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। ফুলটি ২০দিন রাখা সম্ভব। আলোর সল্পতায় সন্ধ্যা হলেই ফুলটি বন্ধ হয়ে যায় আর ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে মেলে যায় এই ফুল।
ঝিকরগাছার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ বললেন, ‘নেদারল্যান্ডস থেকে গাজীপুরের দেলোয়ার হোসেনের মাধ্যমে সরকারি খরচে আট প্রজাতির পাঁচ হাজার বাল্ব আমদানি করি। ওই বাল্ব গদখালীর ইসমাইল হোসেনের ৫ শতক জমিতে গত ৬ জানুয়ারি বপন করা হয়। ২২ জানুয়ারি থেকে টিউলিপ ফুল ফুটতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে সানরাইজ, অ্যান্টার্কটিকা হোয়াইট (সাদা), লা বেলা রেড (লাল), মিল্কশেক রেড (লাল) প্রজাতির টিউলিপ ফুল ফুটতে শুরু করেছে। পর্যায়ক্রমে আট প্রজাতিরই ফুল ফুটবে বলে আশা করি। আমরা ফুলের রাজ্য গদখালীকে মিনি নেদারল্যান্ডস হিসেবে পরিচিত করে তুলতে চাই।’
নেদারল্যান্ডস প্রতিবছর তিন বিলিয়নের বেশি টিউলিপ কন্দ উৎপাদন করে। দেশটির রপ্তানি আয়েও টিউপলিপের অবদান উল্লেখযোগ্য। সেখানে প্রতি বছর বসন্তে টিউলিপ উৎসব হয়।
বাংলাদেশের মত গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে টিউলিপের বাণিজ্যিক চাষ কতটা সম্ভব, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। তবে এদেশের গাজীপুরের শ্রীপুরের দেলোয়ার হোসেন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের মত করে।
দেলোয়ার জানান, ২০২০ সালে তিনি সীমিত পরিসরে চাষ করে কয়েক রঙের টিউলিপ পেয়েছিলেন। সে সময় রীতিমত হইচই পড়ে গিয়েছিল।দেলোয়ারের টিউলিপ বাগান দেখতে অনেকেই ভিড় করছিলেন তার শ্রীপুরের বাড়িতে।
পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে দেলোয়ারের বাগানে আরও বেশি টিউলিপ ফোটে। সেই চারা ও কন্দ তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। এখন টিউলিপ ঘিরে অনেকের মধ্যেই তৈরি হচ্ছে স্বপ্ন।
দেলোয়ার জানান, দেশে গড় তাপমাত্রা সবচেয়ে কম থাকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) এবং পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের সহায়তায় সেখানকার কয়েকজন প্রান্তিক কৃষক এবার টিউলিপের চাষ করেছেন। সেখানেও এবার ফুটেছে বাহারী রঙের ফুল। কৃষকদের প্রশিক্ষণ, পরিচর্যা, ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন দেলোয়ার হোসেনই।
দেশে টিউলিপের চাষ আরও বাড়াতে এবার নেদারল্যান্ডস থেকে হলুদ, লাল, চার ধরনের পিংক, অরেঞ্জ, সাদা, বেগুনিসহ ১০ ধরনের ৭০ হাজার টিউলিপের বাল্ব আমদানি করা হয়েছে। তেঁতুলিয়ায় ৪০ হাজার, রাজশাহীতে এক হাজার এবং যশোরের গদখালিতে পাঁচ হাজার বাল্ব দিয়ে বাগান তৈরি করে বোঝার চেষ্টা হচ্ছে, দেশে কোন এলাকায় টিউলিপ সবচেয়ে ভালো হতে পারে।
দেলোয়ার বলেন, “আমাদের দেশে ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাহিদা মিটাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ফুল আমদানি করা হয়। ফুল চাষে জড়িয়ে আছে কৃষি অর্থনীতির একটি অংশ। তবে আমরা এ দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে। নানা প্রতিবন্ধকতার পরও থেমে থাকিনি। এরই মধ্যে অনেক ফুল চাষে সফলতা এসেছে। এখন হল সম্প্রসারণের কাজ করে যাওয়া।”
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ফুল গবেষক) ফারজানা নাসরিন খান বলেন, “আমাদের দেশে টিউলিপ ঘিরে এখন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আগে শীতের সময়ে বাসাবাড়ির টবে কেউ কেউ টিউলিপ লাগাতেন। এখন সেটা জমিতে চাষ হচ্ছে এটা সত্যিই আনন্দের খবর। তবে এর সম্প্রসারণে বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারকেও সহায়তার হাত বাড়াতে হবে”।
Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)