শ্যামনগরে পর পর দুই স্বামী হারানো বাঘ বিধবা সোনামণির জীবন কাহিনী

আশিকুজ্জামান লিমনঃ
শ্যামনগরে পর পর দুই স্বামী হারানো বাঘ বিধবা সোনামণির জীবন
কাহিনী। বাঘ বিধবা সোনামণি ছোট বেলায় বাবার বাড়ী সাতক্ষীরার
কালিগঞ্জ উপজেলায় বড় হয়। সংসারের অভাবের কারণে বেশি দিন বাবার ঘরে
থাকতে পারেনি। অল্প বয়সে তাকে ছাড়তে হয় বাবার বাড়ী। ১৫ বছরে
সোনামণির বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। নিজের বংশীয় জেলে সম্প্রদায়ের
সাথে। ভাল ছেলে হওয়ায় হাত ছাড়া করেনি সোনামনির বাবা। বিয়ে দিয়ে
দেয় শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সুন্দরবনের কোল ঘেষে
মুন্সিগঞ্জ গ্রামের জেলে পাড়ার রাধাকান্ত সরদারের সাথে। মা বাবা ভালবেসে
আদরের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে একটু শান্তি চেয়ে ছিলেন। বিয়ের পর পরই
সোনামনির কোল আলো করে জন্ম নেয় এক ছেলে সন্তানের। সোনামনির
মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ভালই চলছিল সোনামনির স্বামীর সংসার। জেলে
পরিবার হওয়া স্বামীর পেশা ছিল সুন্দরবনে মাছ ধরা। কিন্তু বিধির বিধানে
১৯৯৯ সালে তার স্বামী রাধাকান্ত সরদার বনবিভাগ থেকে পাশপার্মিট নিয়ে
সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের কবলে পড়ে আর জীবিত ফিরে আসেনি।
বাঘের কবল থেকে তার স্বামীর লাশ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি সঙ্গিরা। সেই
আক্ষেপ নিয়ে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে সোনামনির মাথায়। সুখের সংসার তছনছ
হয়ে যায়। সোনামনি কিভাবে সংসার চালাবে তা ভেবে দিনের পর দিন
হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। সে সময় স্বামী হারা একজন নারীকে সমাজে
অবহেলার চোখে দেখা হত। দেবরের সংসারে থাকতে অনেক গুঞ্জন শুনতে হয়েছে।
সোনামণির অভাবী বাবার সংসারেও জায়গা হয়নি তার। কাজ না করলে তার ভরন
পোষণের দায়িত্ব বা কে নেবে। পাড়া পড়শিরা অপয়া, স্বামী খেকো, অলক্ষ¥ী
বলে ধিক্কার দিতে থাকে। এক পর্যায়ে পাড়া প্রতিবেশিরা অবিবাহিত দেবর
ভূবেন সরদারের সাথে সোনামনির ২য় বিয়ে পরামর্শ এবং সেই মোতাবেগ
বিয়েও হয়। ভূবেন সরদারও সুন্দরবনে মাছ ধরে উপার্র্জন করত। সোনামনির
দু:খ কিছুটা লাঘব হয়। পিছনের কালো অধ্যায় মুছে ফেলে নতুন ভাবে
স্বামী সংসার শুরু করে সোনামনি। এ সংসারের মধ্যেও কোল আলো করে ফুট
ফুটে এক ছেলে ও দুই মেয়ে সন্তানের জম্ম হয়। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে
ভালই দিন অতিবাহিত করতে থাকে সোনামনি। ২০০৯ সালে আইলার পরপরই
ভূবেন সরদার বনবিভাগ থেকে পাশপার্মিট নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরার জন্য
গেলে বাঘের আক্রমনে মারা যান। প্রথম স্বামীর মত লাশ ফিরিয়ে আনতে
পারিনি সঙ্গীরা। বাঘে ধরে অনেকের লাশ বাড়ীতে ফিরিয়ে আনে কিন্তু
বিধাতার কি করুন পরিনিত সোনামণির দুইটা স্বামীর লাশ পর্যন্ত দেখতে
না পেয়ে আক্ষেপে ফেটে পড়েন। সোনামনির ২য় স্বামীকে হারিয়ে নি:শ্ব হয়ে পড়ে। বাঘে নিয়ে যাওয়ার পর সোনামণির আর জায়গা হয়নি শ্বশুর
বাড়ীতে। নিরুপায় হয়ে ছেলে মেয়েদের বাঁচানোর জন্য জীবন সংগ্রামে
নেমে পড়েন সোনামণি। লোকের বাড়ীতে দিন মজুরি, মাছ ধরা সহ
বিভিন্ন কাজ করে সংসার চালান। ছেলে মেয়েরা বড় হতে থাকে। নিজের
সংগ্রামী করে রোজগার করা অর্থ দিয়ে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই
ছেলে নিয়ে তার স্বপ্ন ছিল সুখে হওয়ার। কিন্তু ছেলেরা বড় হলে বৌমা
আনেন সোনামনি। তাদের সংসারে বনিবনা না হওয়াতে দু:খের সংসারে
পৃথক করে দেওয়া হয় মা সোনামনিকে। জাগয়া জমি বলতে জেলেপল্লীতে
ছোট একটা কুঠিঘর মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু ছাড়া কিছু নেই। এই
পরিস্থিতে সোনামনি বিভিন্ন কাজ করে নিজের সংসার অতিবাহিত
করেন। ছেলে মেয়েদের নিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখলেও সে সুখ ভোগ করতে
পারিনি। সোনামনি বেসরকারি সংস্থা লিডার্স এর বাঘ বিধবা দলের
একজন সদস্য হন। সেখান থেকে কিছু সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। বাঘ
বিধবা সোনামণি জানান, সুন্দরবনে বাঘের আক্রমনে আমার পর পর দুই
স্বামী বাঘের আক্রমনে নিহত হয়। কিন্ত লাশ পর্যন্ত ফিরে পাইনি। আমি
অনেক কষ্ট করে সন্তানদের বড় করেছি। তারাও আমাকে আলাদা করে রেখেছে।
এখন এই বয়সে নিজের রোজগার করে নিজেকেই খেতে হয়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)