কালিগঞ্জে এবার নামের আগের ‘ডাক্তার’ টাইটেল মুছে ফেললেন কথিত সেই চিকিৎসক দম্পতি
ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি:
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের কৃষ্ণনগরে বহু সমালোচিত হোমিও চিকিৎসক রেজাউল ও তার স্ত্রী রিমা আক্তার তাদের নামের আগের ‘ডাক্তার’ টাইটেল মুছে ফেলেছেন। বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় সাইনবোর্ডে রেজাউল ইসলাম ও রিমা আক্তারের নাম থাকলেও তাদের নামের আগের ‘ডাক্তার’ শব্দটি সাদা রং দিয়ে মুছে ফেলা হয়েছে।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে এই দম্পতি নিজেদের ‘হোমিও চিকিৎসক’ প্রচার দিয়ে গত কয়েক বছর ধরে প্রতরণার মহা ফাঁদ পেতে অসহায় মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছিলেন মোটা অংকের টাকা। এ বিষয়ে গত (২ সেপ্টেম্বর) দৈনিক সাতক্ষীরায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের পর থেকেই নিজেদের বাঁচাতে বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্তা ব্যক্তিদের কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন রেজাউল ইসলাম ও তার পিতা সামছুর রহমান। সর্বশেষ সাইনবোর্ড থেকে নিজেদের নামের আগে লেখা ‘ডাক্তার’ শব্দটি মুছে ফেলেছেন তারা।
এর আগে স্থানীয় একাধিক ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কথিত ওই হোমিও চিকিৎসক দম্পতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের একটি দল। এরপর তাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসতে থাকে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানী ওই সংবাদকর্মী দলকে আরিফুল ইসলাম, রুবেল হোসেনসহ স্থানীয় অনেকে জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের শংকরপুর গ্রামে নিজেদের বাড়িতে কোহিনুর হোমিও চিকিৎসালয় নামে প্রতিষ্ঠান খোলেন রেজাউল ইসলাম ও তার স্ত্রী। সেখানে সকল রোগের হোমিও চিকিৎসা প্রদান করেন ওই দম্পতি । রোগী দেখলে তাদের ভিজিট দিতে হয় ৩শ টাকা। তবে কম্পিউটারের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করার জন্য তারা নেন ১৫শ টাকা। রোগীদের দেন জার্মানির ঔষধ। এজন্য অধিকাংশ রোগীদের ঔষধ নিতে হয় তিন থেকে চার হাজার টাকার। একজন রোগী গেলেই ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয় কোহিনুর হোমিও চিকিৎসালয়ে। এছাড়া কোন ব্যক্তি যদি তাদের চিকিৎসা কেন্দ্রে রোগী নিয়ে যেতে পারলে রয়েছে কমিশনের ব্যবস্থা এমনই জানালেন তারা।
স্থানীয়দের এমন অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ওই দলটি কথিত চিকিৎসক দম্পতির প্রতারণার ফাঁদ ধরার জন্য উপজেলার মৌতলা এলাকার নাসিমা ও ফাতেমা নামের দুই বোনকে রোগি সাজিয়ে পরিচয় গোপন রেখে রেজাউলের বাড়িতে নিয়ে যান। সুস্থ্য-সবল ওই দুই বোনকে নিয়ে রেজাউলের বাড়ির সামনে গেলেই দেখা মেলে স্বামী আর স্ত্রীর বিরাট সাইনবোর্ড। উভয় সাইনবোর্ডে লেখা কম্পিউটারের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে জার্মানীর ঔষধ দেওয়া হয়।
রেজাউলের বাড়িতে ঢুকার পর প্রথমে একটি গোল ঘরে সবাইকে বসতে দেওয়া হয়। এরপর একজন এসে জানান ডাক্তার চেম্বারে এসেছে। পরে সেই দুইজন নারীকে নিয়ে পরিচয় গোপন রেখে ভেতরে প্রবেশ করেন ১ জন সংবাদকর্মী। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক রেজাউল চেম্বারে ভিষণ গভীর মনোযোগ সহকারে রোগীকে দেখতে থাকেন। এরপর হাতে একটি এনালাইজার মেশিন দিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে ওই দুই বোনের লিভারের সমস্যা আছে বলে জানান। কথাটি শোনার পর সাংবাদিকসহ চিকিৎসা নিতে আসা দুই বোনই রিতিমত আৎকে উঠেন। তবে কথিত ডাক্তার রেজাউল তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন, সমস্যা নেই আমি এই রোগের চিকিৎসা করে দিলে সব সমাধান হবে যাবে। তবে আমার ভিজিট দিতে হবে ৩শ টাকা, টেস্ট ১১শ’ টাকা আর ঔষধ ৪ হাজার টাকা।
রেজাউলের এ কথায় রাজি হয়ে যায় সাজানো ওই দুই রোগীসহ তাদের সাথে থাকা সংবাদকর্মী। তবে ওই সংবাদকর্মী ডা. রেজাউলের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতে থাকলে একপর্যায়ে বিষয়টি কিছুটা বুঝতে পেরেই রেজাউলের বাবা, মা আর স্ত্রী সাংবাদিকদের ঘিরে ফেলে অশালীন আচারণ আর ভিডিও করতে শুরু করেন। তখন সংবাদকর্মীরা পরিচয় দিলে তারা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্তাদের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালান।
ওই সময়ে সাংবাদিকরা রেজাউলের বক্তব্য নিতে চাইলে বক্তব্য না দিয়ে উল্টো খারাপ আচারণ করে সাংবাদিকদের নামে চাঁদাবাজির মামলা করার হুমকি দেন।
সেসময় কোন রকমে ওই চিকিৎসালয় থেকে বেরিয়ে সংবাদকর্মীরা আরও গভীর অনুসন্ধান শুরু করলে রেজাউল ও তার স্ত্রীর দ্বারা প্রতারণার স্বীকার অনেকের খোঁজ পান। তাদের মধ্যে একজন উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের দুদলি গ্রামের আল-আমিন।
আল-আমিন বলেন, আমার স্ত্রী বেশ কিছুদিন যাবত শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য রেজাউলের বাড়িতে যাই। ওই সময়ে বিভিন্ন টেস্ট করার নামে আমার কাছ থেকে তিনি মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
একই অভিযোগ করেন সাবিনা খাতুন ও শফিকুল ইসলাম নামে দুই ব্যক্তি। তারা বলেন, পেটে ব্যাথা নিরাময়ের জন্য রেজাউল ডাক্তারের বাড়িতে গেলে হাতে একটি ম্যাশিন দেন রেজাউল। এরপর রেজাউল বলেন, তাদের নাকি লিভারে সমস্যা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানান তারা।
এভাবে আরও অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে চিকিৎসার নামে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ডা. রেজাউল ইসলাম দম্পতি। তবে রেজাউল ইসলামের হোমিওপ্যাথি পড়ালেখার ব্যাপারে জানার জন্য তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংবাদকর্মীদের কোন উত্তর না দিয়ে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। পরে গত ৭সেপ্টেম্বর তার বাবা সামছুর রহমান তরফদার নিজের ছেলের পক্ষে সাফাই দিয়ে তার ছেলে মো. রেজাউল করীম ২০০৯ সালে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ড, ঢাকার অধীনে ডিপ্লোমা ইন হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন এন্ড সার্জারী পাশ করেছেন বলে দাবি করেন। তবে সাইনবোর্ডে তার পুত্রবধূর নামের পাশে ডিএইচ.এম.এস অধ্যায়নরত লেখা থাকলেও নামের আগে ঠিকই ডাক্তার লেখা ছিল। একজন পাশ না করে অধ্যায়নরত অবস্থায় নিজের নামের আগে কিভাবে ডাক্তার টাইটেল ব্যবহার করেন এনিয়েও স্থানীয় সচেতন মহলে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ তাদের নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর নিজেদের নামের আগের ‘ডাক্তার’ টাইটেল মুছে ফেলেছেন তারা।
Please follow and like us: