রোহিঙ্গা ঢলের ৪ বছর: শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন, টাল-বাহানা করছে মিয়ানমার
নিউজ ডেস্ক:
মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী ও সেদেশের রাখাইনদের অত্যাচার নির্যাতন ও নিধন অভিযানের মুখে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অভিমুখে যাত্রা করে। তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার সেই ঢল। আশ্রয় নেয় একে একে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা।
আজ ২৫ আগস্ট ২০২১ চার বছর পূর্ণ হলো সেই ঢলের। রোহিঙ্গা সংকটের চার বছর পার হলেও প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি নেই। এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন। উল্টো রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেয়ার জন্য নানা টাল-বাহানা করছে মিয়ানমার।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৩৪টি ক্যাম্পে বসবাস করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছে আরো ১ লাখ ৩১ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার ভারে কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফের মানুষ জর্জরিত।
বন বিভাগের হিসাব মতে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে সাড়ে ৬ হাজার একর বনভূমি বেদখল হয়ে গেছে। অকল্পনীয় ক্ষতি হয়েছে পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যের। পাহাড় কাটায় ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন হয়েছে। ফলে জীব-জন্তুর আবাসস্থল নষ্ট হওয়ায় বন্যপ্রাণীরা বার বার লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। বিশেষ করে হাতি পড়েছে মহা বেকায়দায়। এমনকি চলতি বছর খাদ্যাভাবে পড়ে তিনটি হাতির মৃত্যু হয়েছে।
সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস ও কার্যক্রমের প্রভাব পড়েছে আশপাশের বিস্তৃত এলাকায়ও। নষ্ট হয়েছে কয়েক হাজার একর কৃষিজমি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে বন ও জীব-বৈচিত্র্য যেমন বিপন্ন হবে, তেমনি মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে এ অঞ্চল।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দ্বি পাক্ষিক, বহু পাক্ষিক ও জাতিসংঘ পর্যন্ত তদবির চালানো হয়েছে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক অনাগ্রহের কারণে এখনো পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯। এসব কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দিনদিন অনিশ্চয়তার দিকে এগুচ্ছে বলে মনে করেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ। তবে প্রত্যাবাসন নিয়ে এখনো আশাবাদী প্রত্যাবাসন সংগ্রাম জাতীয় কমিটির সভাপতি আতা উল্লাহ খাঁন।
রোহিঙ্গা নেতা কামাল হোসেন বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বদলে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের অপরাধী প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার সরকার। ২০১৯ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলাটি প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের লক্ষ্য। এ কারণেই রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরার সব রকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে।
আরেক রোহিঙ্গা নেতা কলিম উল্লাহ বলেন, আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। তবে মিয়ানমার সরকার আমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার কথা বললেও ফিরিয়ে না নেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তার দাবি, ক্যাম্পে এখন যেসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে সবই হচ্ছে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর ইশারায়। এসব অপকর্মের সঙ্গে সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গাদের কোনো সম্পর্ক নেই। মিয়ানমারের ইশারায় আল-ইয়াকিন ও আরসার নামে ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা।
আবদু শুকুর নামের ১৯ নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গা বলেন, আত্মঘাতী রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসাসহ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, আগে যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে শুধু ইয়াবা আনত এখন তাদের হাতে হাতে অস্ত্র। আবার তারাই অপহরণসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
তিনি আরো বলেন, আশঙ্কা করা যেতে পারে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী প্রমাণে মিয়ানমার সরকার ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দিয়ে বড় ধরনের সংঘাত সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
পুলিশের দেয়া তথ্যানুযায়ী, গেল চার বছরে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নানা অপরাধে অন্তত ১২শ’ মামলা হয়েছে। গেল ৪ বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২/১৪ ধরনের অপরাধে কম-বেশি ৭৪১টি মামলা হয়েছে। যাতে আসামি হয়েছেন ১ হাজার ৮৭১ জন রোহিঙ্গা। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে— অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি, হত্যা ও মানবপাচার।
সোনা চোরাচালান, হুন্ডি ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী নানা অপকর্ম ও অপরাধে জড়িত হচ্ছে বিপথগামী রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আশার আলো দেখতে না পাওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যেও ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের কাছে উখিয়া টেকনাফের সাড়ে ৬ লাখ মানুষ আজ জিম্মি। কক্সবাজার পর্যন্ত যাতায়াত করতে কমপক্ষে ৭/৮টি চেকপোস্টে তল্লাশি করা হয়। তবুও অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
তিনি আরো বলেন, একে একে চারটি বছর পার হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও স্বদেশে ফেরানো যায়নি। এটা খুবই দুঃখজনক। না হলে যে হারে রোহিঙ্গারা অপরাধ করে বেড়াচ্ছে তাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়বে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অগ্রগতি বিষয়ে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, প্রত্যাবাসনের বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দ্বি পাক্ষিক, বহু পাক্ষিক ও জাতিসংঘ পর্যন্ত তদবির চালানো হয়েছে।
একজন রোহিঙ্গাকেও গত চার বছরে ফেরাতে না পারার হতাশার কথা সম্প্রতি জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত জনগণ, আমরা কিছুদিনের জন্য তাদেরকে এখানে আশ্রয় দিয়েছি। আমাদের অগ্রাধিকার ইস্যু হচ্ছে তারা ফিরে যাবে।
তিনি বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারও বলেছে, তাদেরকে নিয়ে যাবে। চার বছর হল যায় নাই, তারা কিন্তু কখনও বলে নাই, নেবে না। আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে তাদের ফেরত পাঠানো।
জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য সরকার সব ধরনের চেষ্টা ও মিয়ানমারের ওপরে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রেখেছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. হুমায়ূন কবির জানান, সাড়ে ৬ হাজার একর বন ধ্বংস করে রোহিঙ্গারা বসতি গড়ে তুলেছে কিন্তু অবশিষ্ট যে বন রয়েছে সেখানে ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে পরিবেশ, জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। বনকর্মীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
এদিকে উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী দিয়েছেন আরো ভয়াবহ তথ্য। সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে তার ইউনিয়নে রয়েছেন ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। আর পালংখালী ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।
তিনি জানান, রোহিঙ্গারা তার এলাকায় রাম রাজত্ব কায়েম করেছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়সহ যাবতীয় অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে রোহিঙ্গারা। ইউনিয়ন পরিষদের রোহিঙ্গাদের বিচার করার ক্ষমতা নেই। তাই প্রতি রাতে তার ইউনিয়নের কোনো না কোনো গ্রাম থেকে নিরীহ লোকজনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, আর আদায় করছে লাখ লাখ টাকার মুক্তিপণ। টাকা দিতে না পারলে খুনও করছে তারা।
উল্লেখ্য, গেল ৪ বছরে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনের আস্তানা যৌথবাহিনী গুড়িয়ে দিয়েছে একাধিক বার। অস্ত্রসহ আটক হয়েছে শতাধিক সন্ত্রাসী। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৪০ জন।