দেবহাটায় খুনের মোটিভ উদঘাটনে তৎপর পুলিশ, চলছে জিজ্ঞাসাবাদ: হত্যাকান্ডের আগে জুয়েলের কাছে আসা দুই বাইক আরোহীর খোঁজে পুলিশ

নিজস্ব প্রতিনিধি:

বুধবার রাতে দেবহাটা থানা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই নিজ বাড়ীতে দূর্বৃত্তদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন আশিক হাসান জুয়েল (৩২)। মাথায় হাতুড়ি জাতীয় ভারী বস্তুর আঘাত ও নাকের উপরিভাগে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের ফলে রক্তক্ষরণ ও পরবর্তীতে দেহটি পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়ার কারনে জুয়েলের মৃত্যু হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারনা পুলিশের।

দেবহাটা পোষ্ট অফিস  সংলগ্ন এলাকার মৃত আনিছুর রহমানের ছেলে জুয়েল ছিলেন ওই এলাকার অন্যতম ধর্নাঢ্য পরিবারের সন্তান। বাড়ি, একাধিক পুকুর এবং বাকি অংশে গাছপালা ও ঝোপঝাড়ে বেষ্টিত প্রায় ৩০ বিঘা সম্পত্তির ভুতুড়ে বসতভিটায় বৃদ্ধ মা ও একমাত্র শিশুপুত্রকে নিয়ে বাস করতেন জুয়েল। সম্পত্তি দেখাশুনা ছাড়া অন্য তেমন কোন পেশা ছিলনা তার। দুই ভাইয়ের মধ্যে জুয়েল ছিল ছোট। তার বড় ভাই রাজু দীর্ঘদিন ঢাকায় থাকেন। অঢেল সম্পদের মালিক জুয়েল গেল কয়েক মাস আগে বেশ দামী ব্রান্ডের একটি প্রাইভেট কার কেনেন। যেটি প্রায় তার বাড়ির আঙিনায় রাখতেন তিনি।

বছর খানেক আগে অন্যত্র বিয়ে করে শিশুপুত্র আরিয়ানকে জুয়েলের কাছে রেখে সংসার ছাড়ে তার স্ত্রী। সেই থেকে মনমরা জুয়েল প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বাড়ির আঙিনায় থাকা নিজের এসি প্রাইভেটকারের মধ্যে অথবা বাড়ির পিছনের দিকে পুকুরের সিড়িতে বসে সময় কাটাতেন। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে জুয়েল ছিলেন মাদকাসক্ত।

সন্ধ্যার পর ওই প্রাইভেটকারের মধ্যে অথবা পুকুর পাড়ে নির্জনে বসে মাদক সেবন করতো সে। মাদক বিকিকিনির সাথে জড়িত একাধিক ব্যাক্তি জুয়েলের বাড়িতে মাদকদ্রব্য পৌঁছে দিতো। মাঝে মধ্যে সন্ধ্যার পর জুয়েলকে সঙ্গ দিতে ওই পুকুর পাড় বা প্রাইভেট কারে আসতো চেনা অচেনা অনেকেই। নিয়মিত তার পাশের ব্যাক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পাশ্ববর্তী এলাকার ইমরোজ আলী ওরফে চোর ইমরোজ।

প্রায় দিন দশেক আগে জুয়েলের বাড়ি থেকে কাজ ছেড়ে চলে যায় গৃহপরিচারিকা টাউনশ্রীপুরের হোসেন আলীর স্ত্রী রওশন আরা। মায়ের সাথে মনোমালিণ্য থাকায় গেল কয়েক মাস যাবৎ হোটেল থেকেই তিনবেলা খাবার আনিয়ে খেতেন জুয়েল।

বুধবার সন্ধ্যার পর বাড়ির অপর কাজের ছেলেটিকে খাবার আনতে হোটেলে পাঠিয়ে জুয়েল বাড়ির পিছনের পুকুরের সিড়িতে বসে ছিলেন। আর তার শিশুপুত্রকে নিয়ে বৃদ্ধ মা শুয়ে ছিলেন ঘরে। রাত সোয়া ৮ টার দিকে একটি মোটর বাইকে দুজন ব্যাক্তি বাড়িতে ঢুকে জুয়েলকে খোঁজ করে। অন্ধকারে বাইক আরোহীদের না চিনলেও তাদেরকে জুয়েলের সঙ্গী ভেবে পুকুর পাড়ের দিকে যেতে বলেন মা। এরপর তারা দুজন জুয়েলের খোঁজে পুকুর পাড়ের দিকে চলে গেলে জুয়েলের মা-ও এশার নামাজে দাড়িয়ে পড়েন।

পুলিশের ধারনা ওই সময়েই পুকুরের সিড়িতে নৃশংসভাবে জুয়েলকে হত্যা করে তার দেহটি টেনে হিচড়ে নিয়ে অপর পাশের আরেকটি পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায় দূর্বৃত্তরা। রাত ৯টার পর তাকে খুজতে গিয়ে পুকুরের সিড়িতে রক্ত পড়ে থাকতে দেখে রক্তের দাগ অনুসরণ করে পুকুরে জুয়েলের লাশ দেখতে পান স্বজনরা। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে গায়ে টিশার্ট পরিহিত ও শরীরের নিন্মাংশ বিবস্ত্র অবস্থায় জুয়েলের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধারকালে জুয়েলের জুতো মিললেও তার কাছে থাকা মোবাইল ফোন, পরিহিত লুঙ্গি এমনকি হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রের এখনও কোন সন্ধান মেলেনি। অন্যদিকে হত্যার আগমুহুর্তে জুয়েলের কাছে আসা ওই দুই বাইক আরোহী কারা ছিলো এবং নৃশংসতম এ হত্যাকান্ডের মোটিভ কি সেবিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি জুয়েলের পরিবার ও পুলিশ।

বৃহষ্পতিবার সকালে ময়নাতদন্তের জন্য জুয়েলের লাশ সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে প্রেরণ করে পুলিশ। দিনভর একাধিকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করেন সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সজীব খান, দেবহাটা সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার এসএম জামিল আহমেদ, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি ইয়াছিন আলম চৌধুরী, দেবহাটা থানার ওসি বিপ্লব কুমার সাহা, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ফরিদ আহমেদসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা।

সহকারী পুলিশ সুপার এসএম জামিল আহমেদ বলেন, নিহতের লাশটি ময়না তদন্তের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। হত্যাকান্ডের আগে জুয়েলের কাছে ওই দুই বাইক আরোহীর খোঁজ চলছে। জুয়েলের নিকটতম সহযোগী ইমরোজ ও গৃহপরিচারিকা রওশন আরাকে থানা হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হত্যার মোটিভ ও খুনীদের সনাক্ত করতে আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ অ্যানালাইসিস সহ পুলিশের সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে এরিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ময়নাতদন্ত শেষে জুয়েলের লাশ তার বাড়িতে দাফনের অপেক্ষমান ছিল এবং এঘটনায় অদ্যবধি কোন মামলা ঋজু হয়নি বলে নিহতের পরিবার ও পুলিশ সুত্রে জানা গেছে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)