সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর আজ: প্রাণ হারায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ

ভয়াল ১২ নভেম্বর আজ। উপকূলবাসীর জন্য বিভীষিকাময় এক দুঃস্বপ্নের দিন। ৫০ বছর পূর্বে ১৯৭০ সালের এই দিনে মহাপ্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষত-বিক্ষত হয় এ অঞ্চলের জনপদ। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর, বাগেরহাট, ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালী, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালীসহ উপকূলের ১৮ জেলা।

প্রাণ হারায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। ভেসে যায় লাখ লাখ গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি। ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাঠের ফসল, উপড়ে পড়ে অসংখ্য গাছপালা। মুহূর্তেই পুরো উপকূল ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে উপকূলবাসীর মনে।

সেদিন সকাল থেকেই গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। সন্ধ্যায় বৃষ্টির সঙ্গে হালকা বাতাস বইতে শুরু করে। তখনো উপকূলবাসী বুঝতে পারেনি কি হতে যাচ্ছে। গভীর রাতে প্রায় ২২২ কিলোমিটার গতিবেগে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াল থাবায় উপকূলীয় জেলাগুলো সব উলট-পালট করে দেয়।

ঘূর্ণিঝড়ের সময় বেতার ও টেলিভিশনে আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনার এখনকার মতো জোরদার ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি ছিল না কোনো আশ্রয়কেন্দ্র। নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকলেও এত মানুষের প্রাণহানি হত না বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মনপুরাবাসীকে সমবেদনা জানাতে হেলিকাপ্টারে ছুটে এসেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি প্রত্যেকটি পরিবারের স্বজন হারানো মানুষের সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানান। পরে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেন।

বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়টি পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঝড় হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। চলতি বছরের ১৮ মে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতী আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে।

তালিকার শীর্ষ প্রাণঘাতী ঘটনা হিসেবে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ ঝড়টিকে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এতে বলা হয়, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নবেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের ভয়াবহ প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। সরকারি হিসেবে এতে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ মারা যান। তবে বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি ছিল।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ‘৭০-এর আগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন’-এ প্রায় ২ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এরমধ্যে এক লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জ তথা বর্তমান বরিশাল অঞ্চলে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানা যায়। ওই ঘূর্ণিঝড়েও ২ লাখ লোক প্রাণ হারান।

১৯৭০-এর পরের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ছিল ভয়াবহ। এতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর, ২০০৮ সালের ৩ মে নার্গিস, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর নিলোফার, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানুসহ বেশকিছু ছোট-বড় ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে। তবে ৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা অন্য কোনো ঝড় অতিক্রম করতে পারেনি।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)