সালমান শাহ খুনের রাজসাক্ষী হতে ৭ কোটি টাকার চুক্তি ছিল : রিজভী

অমর নায়ক সালমান শাহ মৃত্যুর পরের বছর ১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ নামের এক যুবক গ্রেফতার হন। বলা হয় তিনি সালমান শাহের খুনের সঙ্গে জড়িত। ওই খুনের মামলার রাজসাক্ষী হিসেবেও আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আটক হওয়ার কিছুদিন পর জামিনে ছাড়া পেয়ে দেশান্তরি হন রিজভী। তারপর আর তাকে দেখা যায়নি কোথাও।

দীর্ঘদিন পর আবারও তিনি আলোচনায় এলেন পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর। সালমানের পরিবারসহ অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, সালমান খুনের রাজসাক্ষী হওয়া সেই রিজভীর সঙ্গে যোগাযোগ না করে পিবিআই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এটি তাই অসম্পূর্ণ।

দীর্ঘ আলাপচারিতায় মুখোমুখি হয়েছেন রিজভী। সেই আলাপের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলো-

সালমান শাহের খুনে জড়িত বলে গ্রেফতার হয়েছিলেন আপনি ১৯৯৬ সালে। রাজসাক্ষীও হয়েছিলেন। পরে জানা যায় আপনি সাজানো সাক্ষী…..
রিজভী : আমি কখনোই রাজসাক্ষী ছিলাম না। আমাকে রাজসাক্ষী বানানো হয়েছে। নাটকীয়ভাবে আমাকে দিয়ে তারা এসব সাজিয়েছে। নীলা চৌধুরী, ওসি বদরুল, আরও অনেকেই ছিলেন এই পরিকল্পনায়। সত্যি কথাটা হলো ক্যান্টনমেন্ট থানা বা সিএমএম কোর্টে-আদালতে আমি কোনো জবানবন্দি দিইনি। আমি কোনো রাজসাক্ষী নই। বারবার এই মিথ্যে কথাটা বলা হচ্ছে। আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া ওই জবানবন্দি আমার নয়। সেখানে স্বাক্ষরটিও জাল। আমাকে তো চুক্তির বরখেলাপ করে দুদিন পরই কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হলো। সেখানে ৯ মাস বন্দি ছিলাম। আদালতে আমি কোনো জবানবন্দি দিইনি।

এই ঘটনায় আপনি কীভাবে জড়িত হয়েছিলেন….?
রিজভী : আমি ছিলাম সালমান শাহের অন্ধ ভক্ত। এখনো। ১৯৯৬ সালে আমার বয়স ১৫ বছর। আবেগ ছিলো অন্যরকম। প্রিয় নায়কের মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারিনি। আবেগে একটি মিথ্যে ও সাজানো নাটকে জড়িয়ে পড়েছিলাম।

তখন নীলা চৌধুরী সালমান শাহ ভক্তদের কাছে মায়ের মতো আবেগের জায়গায় সম্মান পেতেন। আমারও যোগাযোগ ছিলো তার সাথে। একদিন গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে নীলা চৌধুরী গাড়ি পাঠায় আমাকে তার বাসায় যাওয়ার জন্য। সেদিন বাসায় সালমান শাহের কয়েকজন আত্মীয় ছিলেন, বেশ ক’জন সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ ছিলেন। সবাই মিলে পরিকল্পনা সাজায় আমাকে গ্রেফতার দেখিয়ে খুনের মামলাটি চালানো হবে। আমি রাজি হচ্ছিলাম না দেখে আমাকে ৭ কোটি টাকা দেয়ার চুক্তি হলো।

পরবর্তীতে কী হলো…..?
রিজভী : আমাকে ঠকানো হয়েছিলো। বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিলো আমার সাথে। নীলা চৌধুরী বেঈমানী করলো। আমার জেলখানায় যাওয়ার কথা ছিলো না। ওসি বদরুল আমাকে বলেছিলেন দুইদিন আটক থাকতে হবে। কিন্তু দুইদিনের মধ্যে আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হলো। দীর্ঘ নয় মাস আমি সেখানে বন্দী ছিলাম। আমার সাথে পরিবারের কেউ যোগাযোগ করতে পারতো না। মা-বাবা, ভাইবোন কারো মুখ দেখিনি নয় মাস। বুঝতে পারলাম যে অনেক বড় ভুল করেছি। কেন্দ্রীয় কারাগারে বেশ কয়েকজন সিআইডি অফিসার আমার জবানবন্দি নিলেন। তাদের আমি সব খুলে বলি। সব বানানো ছিলো। সালমান শাহ সিনেমা করে গেছেন সত্যের মৃত্যু নেই। তার মা অভিনয় করে যাচ্ছেন সত্যের মৃত্যু ঘটাতে।

খুব খারাপ লাগতো। বুঝতে পারছিলাম অহেতুক একটা খুনের মামলা সাজানো হয়েছে। নীলা চৌধুরীর অসৎ উদ্দেশ্য আছে। তিনি পুত্রশোককে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। এখন তো স্পষ্ট দেখি দিনের পর দিন চাঁদাবাজি করে মামলার টাকা উঠানোর নামে ফায়দা লুটছেন তিনি।

এরপর সালমান শাহের পরিবারের সাথে আপনার যোগাযোগ হয়নি আর…..?
রিজভী : না। ওদের সাথে যোগাযোগ করবো কি, আমার লজ্জা করে এটা ভাবতে নীলা চৌধুরীর গর্ভে সালমান শাহ জন্মেছেন। উনি অত্যন্ত ভয়াবহ মানসিকতার একজন নোংরা মানুষ। একটা মৃত্যুকে তিনি মূলধন হিসেবে নিয়েছেন। আমরা কষ্ট করে টাকা আয় করি। আর নীলা চৌধুরীর কোনো কষ্ট নেই৷ তার ইনকামের সোর্স সালমান শাহ। মরা ছেলেকে নিয়ে ব্যবসা করছেন। লন্ডনের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট থেকে চাঁদা উঠাচ্ছেন, সাংবাদিক সম্মেলন করছেন।

যতদূর জানা গেছে, আপনি এবং সালমান শাহের মা ও ভাই একই এলাকায় থাকেন ইংল্যান্ডে। তবুও যোগাযোগ হয়নি…..?
রিজভী : হ্যা, তাদের বাসার সামনেই আমি থাকি। দেখা হয় না। কিন্তু নীলা চৌধুরী ও তার ছেলের অনেক খবরই পাই। নীলা চৌধুরীকে কে চিনে? তাকে চেনার দরকারটাই বা কী। সালমান শাহের মা বলে তাকে মানুষজন চেনে, তার প্রতি আবেগ দেখায়। আর সেই আবেগ বিক্রি করেই তিনি দিনের পর দিন ফায়দা লুটে চলেছেন। তিনি যাকে তাকে গালি দেন, গরীব বলেন। শাবনূরকে বলেছেন দ্বিতীয় শ্রেণির মেয়ে। আমাকেও কয়দিন আগে বলেছেন আমি নাকি ফকিরনির ছেলে।

আমি শাহীন ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলাম। আমার কয়েক পুরুষ ইংল্যান্ডে বাস করে। আমি নিজেও দুই দশক ধরে এখানে আছি নাগরিক হিসেবে। আমি ইংল্যান্ডের পাসপোর্ট ব্যবহার করি। ব্যবসা করে খাই। আল্লাহর রহমতে আমার হাত পাততে হয় না, মিথ্যে চাঁদাবাজি করতে হয় না। আর নীলা চৌধুরী বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিয়ে ইংল্যান্ডে থাকে। কে কেমন সেটা বোঝা যায়। আমি বললাম তো, সালমান শাহের মা পরিচয় ছাড়া নীলা চৌধুরীর কিছু নেই।

আপনার সাথে ১৯৯৬ সালে যা হয়েছিলো সেটা যদি অন্যায় হয় তাহলে জন্য আপনি বা আপনার পরিবার কোনো আইনি ব্যবস্থা নেননি কেন…..?
রিজভী : সমাজে আমার পরিবারের একটা ইমেজ আছে। আমরা এ নিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ি হোক তা চাইনি। আমার মামা ছিলেন ডিআইজি স্টাফ অফিসার। তারও ইমেজের সমস্যা হতো। এসব কারণেই কোনো জটিলতায় যাইনি আমরা।

আর ঘটনার পর আমি ইংল্যান্ড চলে আসি। এ নিয়ে আর কিছু ভাবিনি কোনোদিন। সালমান শাহের পরিবারকে আমি ঘৃণা করি। তবে এখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা কিছু বললে আমি আইনি ব্যবস্থা নেবো। আইনজীবীর সাথে কথাও বলেছি আমি।

এবার যে পিবিআই তদন্ত করেছে সেখানে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রতিবেদন দিয়েছে। সালমান শাহের পরিবার এই প্রতিবেদন প্রত্যাখান করেছে। তারা দাবি আপনি এই মামলার রাজসাক্ষী। আপনাকে কেন ডাকেনি পিবিআই…..?
রিজভী : ভুল। আমি একটা কথা বলতে চাই, সালমান শাহের হত্যা রহস্য নিয়ে পিবিআই যেভাবে তদন্ত করেছে তা সত্যিই দারুণ। তাদের সেদিনের লাইভ আমি দেখেছি। নিখুঁত বিশ্লেষণ মনে হয়েছে রিপোর্টকে। তারা আমার আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করে আমার নাম্বার নিয়েছে। আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। আমি ভয়েস ম্যাসেজে আমার জবানবন্দি দিয়েছি। আমি যা জানি সব বিস্তারিত বলেছি। আমার সাথে যা হয়েছিলো সব।

সামিরা বা ডন; এদের সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি এই ২৪ বছরে?
রিজভী : না। কারণ নেই তো। তাদের সাথে আমি কেন যোগাযোগ করবো! তারাও তো আমাকে পছন্দ করে না। তারা জানে আমি মিথ্যে রাজসাক্ষী হয়েছি তাদের খুনি দাবি করে। কিন্তু সত্যটা হলো আমি কেবল একটি পরিকল্পিত নাটকের শিকার ছিলাম।

তাহলে এতদিন কেন এটা নিয়ে মুখ খুলেননি?
রিজভী : যে জিনিসটা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, অপমানিত করেছে সে নিয়ে আমি আর আগ্রহী ছিলাম না। আমার পরিবারও চাইতো আমি যেন ওই ট্রমা কাটিয়ে উঠি। এসব থেকে দূরে থাকি। তাছাড়া আমার কাছে তো কেউ আসেনি। বাংলাদেশের সরকার বা মিডিয়া তো আমার খোঁজ করেনি। অনেকদিন পর পিবিআই আমাকে খোঁজে বের করে আমার জবানবন্দি নিয়েছে। আমি যা জানি সব বলেছি। এখন অনেক মিডিয়া আসছে। তাদের সামনে কথা বলছি। প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতেও বলবো।

সূএ-জাগো নিউজ

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)