ভ্যান চালক থেকে চাঁদা নিয়ে কোটিপতি সাতক্ষীরার কাদের

বিভিন্ন যানবাহন থেকে অবৈধ চাঁদা আদায় করে এক সময়ের ভ্যানচালক বর্তমান নারকেলতলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের কাদু এখন কোটিপতি। একাধিক বিয়ের ও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। । বিগত ১০ বছর যাবত নারকেলতলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের শ্রমিকদের ব্যবহার করে প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ চাঁদা আদায় করে নিজের পকেটস্থ করেছেন তিনি।

আর সেই টাকা দিয়ে আলীসান বাড়ীসহ শহরের কয়েক স্থানে জমি কিনেছে সে। অথচ সাতক্ষীরার সাধারণ শ্রমিকদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। এনিয়ে সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও কাদু বাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউনিয়নের একাধিক শ্রমিকরা জানান, বর্তমান নারকেলতলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের কাদু ১৯৮০ এর দশকে ছিলেন ভ্যান চালক। পরবর্তীতে সাতক্ষীরার রসুলপুরের তৎকালীন ট্রাক ড্রাইভার খবিরউদ্দিনের হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করে নারিকেলতলা ট্রাক-ট্যাংকলরী শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য হন। সে সময় সংগঠন পরিপন্থী কার্যকলাপের জন্য বহিস্কৃত হন তিনি। পরবর্তীতে টাউনবাজারের ব্যবসায়ী মাকছুদুর রহমানের ট্রাকে ড্রাইভারী শুরু করে কোন রকম জীবিকা নির্বাহ করতেন।

ওয়ান ইলেভেনের পর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের হাত ধরে পুনরায় শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সদস্য হয়। পরবর্তীতে শ্রমিক ইউনিয়নে আসা সেই মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের আওয়ামী প্যানেলের বিরুদ্ধে জামায়াত-বিএনপির প্যানেল থেকে আব্দুল কাদের কাদু ভূয়া ভোটার তৈরি করে ভোটে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। চক্রান্তের ভোটে আওয়ামী প্যানেল থেকে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক পরাজিত হন। গত ১০বছর যাবত এই কাদু কোন নির্বাচন ছাড়াই অত্র শ্রমিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল তবিয়তে আছে। বর্তমান মেয়াদে অবস্থা বেগতিক দেখে এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেককে ডেকে এনে সভাপতি পদে বসিয়ে নতুন কমিটি গঠন করেছে সে।

৪দলীয় জোট সরকারের সময় যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামী কারাগারে আটক জামায়াতের খালেক মন্ডল এমপি নির্বাচিত হলে তাকে এই কাদু দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে এনে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে। ওয়ান ইলেভেনের পর আব্দুল কাদের কাদু ভোল পাল্টে শ্রমিকলীগের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করে। জেলা শ্রমীকলীগের একজন নেতাকে ম্যানেজ করে জেলা শ্রমিকলীগের সহ-সভাপতি হয়েছে সে কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে।

গত ১০বছর যাবত বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে বাস, ট্রাক, নছিমন, করিমনসহ বিভিন্ন যানবাহন থেকে প্রতি মাসে অবৈধ ভাবে ৬ থেকে ৭ লক্ষাধিক টাকা চাঁদা কালেকশন করা হচ্ছে কাদুর নেতৃত্বে। যার ন্যুনতম অংশ কমিটির অন্য সদস্যদের মাসিক ভাতা বাবদ ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়ে বাকীটা নিজে আত্মসাত করে আসছে। শুধুমাত্র ভোমরা স্থলবন্দর হতে অত্র সংগঠনের নামে প্রতিমাসে লক্ষাধিক টাকা ব্যক্তিগতভাবে আত্মসাত করে। বাইপাস সড়ক চালু হওয়ার পর থেকে প্রতি নছিমন, করিম, ভটভটি, ট্রলি থেকে ২০ টাকা,গরুর ট্রাক ২০০ টাকা, মাছের গাড়ী ১০০টাকা। এতে প্রতিদিন ৮/১০ হাজার টাকা আদায় করে কাদু। যার অর্ধেক সে একাই আত্মসাত করছে।

এছাড়া ভোমরাস্থল থেকে আসা মালমাল ভর্তি ট্রাক পাকিংয়ের নামে ১০০ টাকা জোরপূর্বক আদায় করে। এর মধ্যে ৮০ টাকা গ্রহণ করে ইটাগাছা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন এবং নারকেলতলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন আর বাকী ২০ টাকার ১০টাকা ইটাগাছা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাহাঙ্গীর শাহীন ও ১০ টাকা কাদু ভাগবাটোয়ারা করে নেয়।

বিগত তিন মেয়াদে অনির্বাচিত কমিটিতে নতুন নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেছে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। সর্বশেষ কমিটিতে নির্বাচিত সদস্যদের বাদ দিয়ে জাহিদ হোসেন, সাইফুল ইসলাম ও আশরাফুলকে সদস্য পদে অন্তর্ভুক্ত করেছে কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে। পরবর্তীতে ঝাউডাঙ্গার উক্ত গাঁজা ব্যবসায়ী আশরাফুল র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হলে তার স্থলে নুরুল ইসলাম বাবুকে আবার টাকার বিনিময়ে নতুন সদস্য পদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একইভাবে বিএনপি নেতা কবিরুল ইসলামকে টাকার বিনিময়ে পূর্বের কমিটিতে সদস্য ও বর্তমান কমিটিতে সড়ক সম্পাদক পদে পদায়ন করা হয়েছে। কমিটি ভাঙাগড়ার নামে প্রতি মেয়াদে খুলনাস্থ জেডিএল এর নাম করে কয়েক লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে এই কাদু।

সে সংগঠনে এতটাই প্রভাবশালী যে, সর্ব্বোচ্চ পদে আসীন সভাপতির চেয়ে সাধারণ সম্পাদক কয়েক হাজার টাকা বেশী মাসিক ভাতা উত্তোলন করে আসছে বিগত ১০বছর যাবত। সংগঠনের ৪টি ট্রাক সে নিজেই পরিচালনা করে মাসিক প্রায় ১লক্ষ টাকা মাসোয়ারা নেয়। তাছাড়া, সংগঠনের টাকা আত্মসাৎ করে সে নিজেই ২টি ট্রাক এবং ৫০ বিঘা ঘেরের মালিক বনে গেছে। জানা যায়, তার সকল অপকর্মের হোতা অত্র শ্রমিক ইউনিয়নের কেরানী আশরাফ। বিগত ১৫বছরে কেরানী আশরাফ চার হাজার টাকা বেতন থেকে বর্তমানে দশ হাজার টাকা বেতন পেলেও খুলনা রোডের সন্নিকটে প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে জমি কিনে আলিশান বাড়ি তৈরি করেছে।

অত্র শ্রমিক ইউনিয়নে বিগত ১০বছর যাবত কোন বার্ষিক সাধারণ সভা আহবান করা হয় না। বিগত ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইউনিয়নে কোন নির্বাচিত হয়নি। যে সমস্ত শ্রমিকরা সাধারণ সভার তাগিদ দিয়েছেন ও নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন তাদের অত্র সংগঠন থেকে বহিষ্কার হতে হয়েছে। সংগঠন বা কমিটির কেউ কোন বিষয়ে প্রতিবাদ করলে বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে বিভিন্ন সময়ে অত্র সংগঠনে হামলা ও মারপিট করে তাদের দমন করা হয়।

তার অবৈধ আয়ে সাতক্ষীরা সরকারী কলেজ ও ঝুটিতলা সড়কে কয়েক বিঘা জমি ক্রয় করেছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য কয়েক কোটি টাকা।

সাধারণ শ্রমিকরা জানান, বিগত ২০০৯ সালের পর থেকে সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হয় মো. মিলন রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক রজব আলী, কার্যকরী সদস্য আইয়ুব আলী সরদার ও আব্দুল্লাহ আল মামুন। তাদের বর্তমান কমিটি থেকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বাদ দিয়েছেন আব্দুল কাদের কাদু। সাধারণ শ্রমিকরা অবিলম্বে ইউনিয়নের নির্বাচন ও কাদুর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের কাদুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কখনো তিনি ভ্যান চালক ছিলেন না জীবনের প্রথম থেকেই তিনি ট্রাকের হেলপার ও ড্রাইভার ছিলেন। তাছাড়া তিনি অনেক কষ্ট করে ধন সম্পদ বানিয়েছেন। এছাড়া সাতক্ষীরায় বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কে নিয়ম অনুযায়ী তিনি ২০ টাকা করে চাঁদা তোলেন। তবে অন্য সব অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।

সড়কে চাঁদা আদায় করা যাবে কিনা জানতে চাইলে শ্রম অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়ন) মিজানুর রহমান বলেন,কোন ট্রেড ইউনিয়নের সড়ক ওমহাসড়কে চাঁদা আদায় সম্পূর্ণ অবৈধ। কোন ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান যদি সড়কে চাঁদা আদায় করে আর এবষিয়ে যদি কোন ভুক্তভোগী আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)