প্রযুক্তি যখন প্রতিবন্ধীদের সহায়ক

আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এখন নানা অসম্ভবকেও সম্ভব করা যাচ্ছে। আর সেই সম্ভাবনার রাজ্যে পিছিয়ে নেই প্রতিবন্ধীরাও। যারা জন্মগতভাবে কিংবা দুর্ঘটনার ফলে শারীরিক অক্ষমতার শিকার হয়েছেন, তাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কাজই স্বাভাবিক মানুষের মতো করে করার সুবিধা দিতে কাজ করে যাচ্ছে গবেষকরা। তাতে সাফল্যও মিলছে, তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের প্রযুক্তি পণ্য। প্রতিবন্ধীদের সহায়তায় এমন ধরনের কিছু প্রযুক্তি ও পণ্যের বিষয়ে আলোচনা করা হলো এ লেখায়

হেড মাউস এক্সট্রিম

এটি মূলত একটি তারবিহীন মাউস যা কেবল মাথার নড়াচড়ার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মাথার নড়াচড়ার প্রতিটি অংশকে সনাক্ত করার জন্য এতে রয়েছে একটি তারবিহীন অপটিক্যাল সেন্সর। আর ব্যবহারকারীকে তার কপালে, মাথার কোনো টুপির সাথে অথবা চশমাতে ব্যবহার করতে হবে আরেকটি সেন্সর। এর ফলে ব্যবহারকারী তার মাথা নাড়ালেই সেই অনুপাতে কম্পিউটারে মাউসের কার্সরটিও নড়বে।

কম্পিউটারের সামনে যেকোনো স্থানে বসেই যে কেউ এটি ব্যবহার করতে পারবেন। এটি ব্যবহার করে নানান ধরনের ড্রয়িং, মাউস নিয়ন্ত্রিত গেমিং, নানান ধরনের গ্রাফিক্সের কাজ এবং ক্যাড (CAD)-এর মাধ্যমে নানান ডিজাইনের কাজও করা যাবে। ইউএসবি পোর্টের মাধ্যমেই পিসিতে সংযুক্ত করা যায় এই হেডমাউস এক্সট্রিম এবং এর জন্য আলাদা কোনো সফটওয়্যার ড্রাইভারও দরকার হয় না। এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্রাউজিংসহ সব ধরনের কাজই করা যায়। এটি তৈরি করেছে অরিজিন ইনস্ট্রুমেন্টস।

ডায়নাভক্স আইম্যাক্স সিস্টেম

পক্ষাঘাতগ্রস্তরা যোগাযোগের জন্য তৈরি করা হয়েছে ডায়নাভক্স আইম্যাক্স সিস্টেম। এই ডিভাইসের মাধ্যমে রোগী কেবল চোখের ইশারাতেই অন্যদের সাথে কথা বলার কাজটি করতে পারবে। একটি আই ট্র্যাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে কাজ করে। এই ট্র্যাকিং সিস্টেম একটি অনস্ক্রিন কিবোর্ডে রোগীর চোখের নড়াচড়া সনাক্ত করে সে কী বলতে চায় সেটি বুঝতে পারে। আর সেই অনস্ক্রিন কিবোর্ড থেকে প্রাপ্ত টেক্সটে সরাসরি কথায় রূপান্তর করতে পারে। কিবোর্ড ছাড়াও এতে রয়েছে ইন্টারএসিসিটি ল্যাংগুয়েজ সফটওয়্যার যাতে অনেক শব্দ, বাক্য এবং বাক্যাংশ সংরক্ষণ করা রয়েছে।

রুবি হ্যান্ডহেল্ড ভিডিও ম্যাগনিফায়ার

স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের পড়ার সমস্যা দূর করতে তৈরি করা হয়েছে রুবি হ্যান্ডহেল্ড ভিডিও ম্যাগনিফায়ার। মাত্র ৪.৩ ইঞ্চি আকৃতির এই বিবর্ধক যন্ত্রে রয়েছে উজ্জ্বল রঙের ডিসপ্লে। আর আকারে ছোট হওয়ায় একে সহজেই যেকোনো স্থানে বহন করা যায়। যেকোনো লেখার উপরে একে ধরে লেখার আকৃতি বাড়ানোর বা কমানোর জন্য রয়েছে ‘+’ এবং ‘-’ বাটন। ফলে সহজেই যেকোনো লেখা জুম করা যায়।

পাশাপাশি সহজে পড়ার জন্য যেকোনো লেখার রং এবং লেখার ব্যাকগ্রাউন্ডের রংও পরিবর্তন করা যায়। ‘ফুল কালার’ মোড ছাড়াও এতে রয়েছে চারটি বিশেষ মোড—সাদা রেঙের উপর কালো লেখা, কালো রঙের উপর সাদা লেখা, হলুদ রঙের উপর নীল রঙের লেখা এবং নীল রঙের উপর হলুদ রঙের লেখা। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১৪ গুণ পর্যন্ত বিবর্ধন করা সম্ভব।

ক্যাপ্টেন প্লাস পার্সোনাল নেভিগেশন ডিভাইস

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পথঘাটে সহায়তা করার জন্য তৈরি করা হয়েছে ক্যাপ্টেন প্লাস পার্সোনাল নেভিগেশন ডিভাইস। এটি মূলত একটি জিপিএস ডিভাইস যা বিভিন্ন স্থানের পথনির্দেশনা উচ্চারণ করে দেয় ব্যবহারকারীদের জন্য। এতে বিভিন্ন স্থানের রুট আগে থেকে সংরক্ষণ করে রাখার সুবিধাও রয়েছে। ফলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা এর মাধ্যমে সহজেই বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে পারবে।

হুইল চেয়ার ও কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তি

পক্ষাঘাতগ্রস্তদের জন্য সহায় হয়ে এসেছে প্রযুক্তি। এমন রোগীদের অনেকের পায়ের পাশাপাশি হাতও কর্মক্ষম নয়। ফলে হুইল চেয়ার সঠিকভাবে পরিচালনা করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এই ধরনের রোগীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিং ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একদল গবেষক উদ্ভাবন করেছে বিশেষ ধরনের প্রযুক্তি।

এই প্রযুক্তিতে রোগীর জিহ্বাকে ছিদ্র করে বসানো হয় একটি বিশেষ চুম্বক। একটি বিশেষ সেন্সর এই জিহ্বার নড়াচড়া তথা চুম্বকের নড়াচড়া সনাক্ত করে একে বিশেষ ধরনের কমান্ডে রূপান্তর করতে পারে। আর এর মাধ্যমে হুইল চেয়ার যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তেমনি কম্পিউটারও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ইতোমধ্যেই এই প্রযুক্তি পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনা করা হয়েছে এবং তাতে সফলতাও এসেছে।

টোপাজ এইচডি ডেস্কটপ ভিডিও ম্যাগনিফায়ার

স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের সহায়তায় রয়েছে আরেকটি বিশেষ বিবর্ধক যন্ত্র ‘টোপাজ এইচডি ডেস্কটপ ভিডিও ম্যাগনিফায়ার’। ১১ ইঞ্চি ডিসপ্লেবিশিষ্ট এই যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়েছে একটি হাইডেফিনেশন ক্যামেরা যা এই যন্ত্রে স্থাপিত যেকোনো ছাপা লেখার বিবর্ধিত স্পষ্ট প্রতিরূপ প্রদর্শন করতে সক্ষম। এই যন্ত্রটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন এতে স্থাপিত কোনো কিছুকে বড় করে দেখার জন্য আলাদা করে তা নড়াচড়া করাতে হয় না বরং ডিসপ্লে থেকেই আলাদা আলাদা অংশকে বিবর্ধন করা যায়। এতে নানান ধরনের টেক্সট পড়ার জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক ৩০টি হাই-কনট্রাস্ট টেক্সট কালার মোড। একে ভিজিএ পোর্টের মাধ্যমে পিসিতে সংযুক্ত করে পিসির লেখা বা ছবিও বিবর্ধন করা যায়।

ব্রেইল এজ ৪০

প্রচলিত কিবোর্ড ব্যবহারে অভ্যস্ত নয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা, বিশেষত যারা অন্ধ। কম্পিউটারে যাতে তারা লেখালেখি করতে পারে, সেই লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘ব্রেইল এজ ৪০’। এর মাধ্যমে নোট লেখা ও সংরক্ষণ করা যায় এবং বই বা অন্যান্য ডকুমেন্টস পড়াও যায়। পাশাপাশি এতে রয়েছে শিডিউলার, অ্যালার্ম, ক্যালকুলেটর, স্টপওয়াচ এবং কাউন্টডাউন টাইমার। এতে রয়েছে দুইটি পৃথক পৃথক চারদিকের নেভিগেশন কি এবং ৮টি ফাংশন কি। এটি ইংরেজি, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান এবং ইতালিয়ানসহ বেশকিছু ভাষা সমর্থন করে। একে পিসি বা অন্যান্য কম্পিউটিং ডিভাইসের সাথেও সংযুক্ত করা যায়।

ব্রেইল সেন্স ইউ২

অন্ধদের লেখার জন্য আরেকটি যন্ত্রের নাম ‘ব্রেইল সেন্স ইউ ২’। ১ গিগাহার্জ প্রসেসর এবং ৩২ গিগাবাইট ফ্ল্যাশডিস্ক স্টোরেজের এই ডিভাইস দিয়ে অন্ধরা খুব দ্রুত লিখতে পারবেন। এতে পাঁচটি ভাষায় লেখার সুবিধা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে এসব ভাষার জন্য আলাদা আলাদা ডিকশনারি। অন্ধদের জন্য এটি শিক্ষা সহায়ক উপকরণ হিসেবেও ব্যবহূত হতে পারে। এতে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর। এটি ইথারনেট, ওয়াই-ফাই এবং থ্রিজি নেটওয়ার্ক সমর্থন করে। এতে রয়েছে বেশ কিছু মাল্টিমিডিয়া ফাংশন যার মাধ্যমে অডিও বা এফএম রেডিও শোনা যায়। এতে তিনটি ইউএসবি পোর্টের পাশাপাশি রয়েছে একটি মিনি ইউএসবি এবং এসডি স্লট। আর ব্লুটুথের মাধ্যমে একে ব্লুটুথ সমর্থিত প্রিন্টার বা কিবোর্ডের সাথেও সংযুক্ত করা যায়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)