পরমাণু ঘড়ির দম ফুরাচ্ছে, ইন্টারনেট-জিপিএস বন্ধের শঙ্কা!

বিশ্বজুড়ে সাড়ে ১৯ বছর পর সেই ভয়ঙ্কর বিপদের আশঙ্কাটা ছড়িয়ে পড়েছে। যেটা হয়েছিল ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সালে পদার্পণের সময়ে। যার নাম- ‘ওয়াইটুকে প্রবলেম’!

সেই আশঙ্কাই ফের দেখা দিয়েছে শুক্রবার। পুরো বিশ্বে পারমাণবিক ঘড়ি (অ্যাটমিক ক্লক)-র দম ফুরিয়ে যাবে বলে। ১৯৮০-র ৬ জানুয়ারি চালু হয়েছিল ওই ঘড়ি। সেই ঘড়ির দম ফুরিয়েছিল ১৯৯৯-র ৬ এপ্রিল। এরপর ফের দম দেয়া হয়েছিল সেই পারমাণবিক ঘড়িতে। শুক্রবার মধ্যরাতের পর (৬ এপ্রিল) যার দম ফুরিয়ে যাবে আবার। ১ হাজার ২৪ সপ্তাহ বা ১৯ বছর ৭ মাস পর। তাকে আবার নতুন করে দম দিতে হবে।

এদিকে ওই ঘড়ির উপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল পৃথিবীতে আমি, আপনি-সহ যাবতীয় প্রাণী ও উদ্ভিদের অবস্থান। যার নাম- ‘গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম’ বা জিপিএস। সেই ঘড়ির দম ফুরোলে ভূপৃষ্ঠে ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি, আপনি, তার বাছবিচারের পদ্ধতিতে (জিপিএস) গন্ডগোল হয়ে যাওয়ারই জোর আশঙ্কা।

তথ্য সূত্র বলছে, জিপিএসের উপর নির্ভরশীল ইন্টারনেট। নির্ভরশীল নেট-ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা। নির্ভরশীল পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা অন্তত ৫ হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ। নির্ভর করে রয়েছে সমুদ্র ও আকাশে নেভিগেশনের অনেকটাই।

তাই অনেকের মনেই প্রশ্ন, অনেকটা লোডশেডিংয়ের মতোই মাঝরাতের পর হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাবে না তো বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবস্থা? অকেজো হয়ে পড়বে না তো নেট-ব্যাঙ্কিং, কিছুক্ষণের জন্য হলেও? আচার, আচরণে ‘পাগলামো’ ধরা পড়বে না তো পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা মহাকাশযান আর উপগ্রহগুলির? নেভিগেশনে বড় ধরনের ওলট-পালট হওয়ার ফলে নাবিকরা বিপদে পড়বেন না তো মাঝসমুদ্রে? বিপদে পড়বেন না তো মৎস্যজীবীরা? বিগড়ে যাবে না তো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসানো ভূকম্প বোঝার যন্ত্রগুলি?

জেনে বা না জেনে এ ব্যাপারে আমজনতার যতটা উদ্বেগ, সাড়ে ১৯ বছর আগেকার অভিজ্ঞতার পর অবশ্য ততটা উদ্বেগে নেই বিজ্ঞানী মহল। তাদের অভয় দিচ্ছে আগেভাগে নেয়া কিছু সতর্ক ব্যবস্থা। এরপরও যে প্রশ্নটাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না, তা হল, সেই ব্যবস্থা ঠিক সময়ে যদি কার্যকর না হয়, তা হলে কী হবে?

ঘড়ির নিয়মকানুন বদলালে চিন্তা কমতে পারে-
কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)-র অধিকর্তা জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী অবশ্য আমজনতার সেই আশঙ্কাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে রাজি নন। তার কথায়, ‘যে সময়সীমা ধরে ওই ঘড়িতে দম দেয়া রয়েছে, তাতেই কিছু অসঙ্গতি থেকে গেছে। সাড়ে ১৯ বছর (আরো সঠিকভাবে বললে, ১৯ বছর ৭ মাস) কেন, ওই সময়সীমাটা তো আরো অনেকটাই বাড়ানো যায়। ঘটনাটা হল, ওই ঘড়িটা চালু করা হয়েছিল দশটি ক্যারেক্টার দিয়ে। যেগুলি শূন্য। মানে, দশটা শূন্য। সেই ক্যারেক্টারগুলি বাড়তে বাড়তে বড়জোর ৯ হতে পারে। হতে পারে দশটি ৯। এরপরই সেই ঘড়ির দম ফুরিয়ে যাবে। আর তাতেই ঘটবে বিপত্তি। ঘড়িটা পিছনের দিকে চলতে শুরু করবে। যেন সময়টা পিছিয়ে গেল আচমকা। তেমন কিছু হলে আজ ইন্টারনেটটা পিছিয়ে যেতে পারে সাড়ে ১৯ বছর আগেকার সময়ে! তখন সেটাকে অ্যাডজাস্ট করতে হবে তড়িঘড়ি। দম ফুরিয়ে গেলে আমরা যেমন আবার দম দিই ঘড়িতে।’

জিপিএস পদ্ধতি বলতে কী বোঝায়-
বিজ্ঞানের পরিভাষায় জিপিএস পদ্ধতির আদত নাম- ‘জিও-পজিশনাল সিস্টেম অফ স্যাটেলাইটস’ বা ‘জিপিএসএস’। যে পদ্ধতিতে পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণীর অবস্থান নির্ধারিত হয় নির্দিষ্ট কোনো দেশের নিরিখে নয়, অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশের নিরিখে। সেই অক্ষাংশ বোঝানো হয় অক্ষরেখার মাধ্যমে। যা টানা হয়েছে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিমে। আর দ্রাঘিমাংশ বোঝানো হয় দ্রাঘিমারেখার মাধ্যমে। এটি টানা হয় পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।

এই পদ্ধতিতে কী ভাবে আমার, আপনার অবস্থান মাপা হয়-
সন্দীপ জানাচ্ছেন, তার জন্য একই সঙ্গে লাগবে পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা অন্তত ৪টি কৃত্রিম উপগ্রহকে। ওই ৪টি উপগ্রহ মিলে ঠিক করবে কোন সময়ে পৃথিবীর ঠিক কোন জায়গায় আমার, আপনার অবস্থান রয়েছে। এর ফলে, ওই ৪টি উপগ্রহকেই একই সঙ্গে একই সময়ে আমাকে, আপনাকে দেখতে হবে। না হলে তারা কেউই সঠিকভাবে আমার, আপনার অবস্থান (পজিশন) নির্ধারণ করতে পারবে না। বিভিন্ন দেশের এমন ৩২টি উপগ্রহ রয়েছে কক্ষপথে।

সন্দীপের মতে, ‘সেই উপগ্রহগুলির ব্যাক-আপ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হলে, কক্ষপথে সক্রিয় (অ্যাকটিভ) উপগ্রহগুলির মধ্যে থাকা অটো-সিস্টেম ‘পাগলামো’ করতে পারে। কোনো মহাকাশযান বা উপগ্রহে থাকা থ্রাস্টারে কিছুক্ষণের জন্য হলেও বিগড়ে যেতে পারে। তবে তিন-চার মিনিটের মধ্যে সেই পরিস্থিতি সামলে নেয়ার ক্ষমতা বিশ্বের সব দেশের সবকটি মহাকাশ গবেষণা সংস্থার হাতেই রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।’

কোনো চিন্তা নেই অ্যাস্ট্রোস্যাটের-
ভারতের গর্বের উপগ্রহ ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর সায়েন্স অপারেশনের প্রধান, পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)-এর অধ্যাপক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য যদিও এই আশঙ্কাকে একেবারেই গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তার মতে, ‘আমাদের অ্যাস্ট্রোস্যাটে যে সব যন্ত্রপাতি রয়েছে, তার একটি কি‌ছুটা হলেও জিপিএসের উপর নির্ভরশীল ঠিকই, কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ, জিপিএস ছাড়াও রাশিয়ার জিও-পজিশনাল পজিশনিং সিস্টেম ‘গ্লোনাস’-এর উপর নির্ভরশীল বিকল্প ব্যবস্থাও রয়েছে অ্যাস্ট্রোস্যাটে। ফলে, আমাদের অন্তত কোনও উদ্বেগের কারণ নেই।’

তেমন হলে উপগ্রহের কিছু সিগন্যাল মিস করতে পারে রিসিভার-
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ রেডিওফিজিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্সের অধ্যাপক আশিক পালও ওই আশঙ্কাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে রাজি হননি। তার কথায়, জিপিএস সিগন্যালের রিসিভারগুলিকে এমনভাবে বানানো হয়েছে আর সেগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এমন ভাবে বসানো রয়েছে যে, পারমাণবিক ঘড়ির দম ফুরনোর সময় কোনো উপগ্রহ যদি পাগলামো করে কোনো সিগন্যাল পাঠায়, সেগুলি রিসিভারে ধরা পড়বে না। সেক্ষেত্রে কিছু সময়ের জন্য হলেও উপগ্রহগুলির পাঠানো সিগন্যাল মিস করতে পারে জিপিএস রিসিভারগুলি। মিস হয়ে যেতে পারে উপগ্রহগুলির পাঠানো কোনো গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও।’

সংখ্যা ছেড়ে বর্ণ দিয়ে ‘দম’ দেওয়া যাক ঘড়িতে-
তবে সন্দীপের বক্তব্য, ঘড়ির দম দেয়ার সময় তার ক্যারেক্টারগুলিকে সংখ্যা দিয়ে না ধরে (০ থেকে ৯) তাকে হেক্সাডেসিমাল পদ্ধতিতে ইংরেজি বর্ণনালার ২৬টি বর্ণ দিয়ে করা যেতে পারে। তাতে মাত্র সাড়ে ১৯ বছর পর পর আর ঘড়ির দম দিতে হবে না। তার জন্য হাতে অনেক অনেক গুণ বেশি সময় পাওয়া যাবে।’

উপগ্রহগুলি সম্পর্কে যে কিছুটা আশঙ্কা থেকেই যায়, সে কথা মানছেন খড়্গপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (আইআইটি) জিওফিজিক্সের অধ্যাপক শঙ্কর কুমার নাথও। জিপিএস নিয়ে আশঙ্কায় ভূকম্প মাপার যন্ত্রগুলির কোনো অসুবিধা হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উপগ্রহগুলির ক্ষেত্রে কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে। দেখতে হবে, তারা আগেভাগে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে।’

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)