আগাম কালবৈশাখীতে ঢাকাসহ সারাদেশে নিহত ১৩
মৌসুমী বায়ু আঁখির প্রভাবে আগাম আঘাত হানলো কালবৈশাখী। ঝড়ের তাণ্ডবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুসহ ১৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৮, মৌলভীবাজারে ২, নেত্রকোনায় ১, সুনামগঞ্জে ১ ও কিশোরগঞ্জে ১ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া ঝড়ের কবলে পড়ে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন অন্তত ২০ জন।
রোববার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে ঢাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় কালবৈশাখী ঝড়। কয়েক মিনিটের ঝড়ে গাছপালা উপড়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে বিলবোর্ড ও ওভারহেড বোর্ড ভেঙে পড়ে সড়কে। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যায় কোথাও কোথাও। এতে করে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা।
ঝড়ের আগে দমকা হাওয়ার সঙ্গে বজ্র ও প্রচণ্ড ধূলিঝড় বয়। এরপরই শুরু হয় কালবৈশাখী। এতে বাতাসের গতি ছিল ৭৪ কিলোমিটার। পরে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিও হয়। মাত্র ২০ মিনিটে আবহাওয়া অফিস ১৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করে। নগরীর কিছু কিছু এলাকায় বজ্র বৃষ্টির সঙ্গে বড় বড় শিলাও পড়ে। ঝড় স্বল্পস্থায়ী হলেও এর দু’ঘণ্টা পরও রাজধানীর আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন।
ঢাকায় গাছচাপা, ইটের আঘাত, দেয়ালচাপা এবং নৌকাডুবিতে দুই নারীসহ আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকাডুবিতে নারী ও শিশুসহ চার জনের মৃত্যু হয়।
ঝড়ের সময় পুরানা পল্টন মোড়ে মল্লিক কমপ্লেক্সের ওপর থেকে ইট ও ফুলের টব মো. হানিফ (৫০) নামে এক পথচারীর মাথায় পড়লে তিনি গুরুতর আহত হন। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত হানিফের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুল লতিফ। তিনি ঢাকায় পরিবারসহ দক্ষিণ মুগদায় বসবাস করতেন। মল্লিক কমপ্লেক্সের কোন তলা থেকে ইট ও ফুলের টব পড়েছে তার অনুসন্ধান চলছে।
শেরে বাংলা নগরে ঝড়ের সময়ে গাছে চাপা পড়ে নিহত হয়েছেন মিলি ডি কস্তা (৬০)। তার বাসা মণিপুরীপাড়ায়। তিনি সংসদ ভবন এলাকায় হাঁটতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন বলে জানান শেরেবাংলা নগর থানার ওসি জানে আলম।
মিরপুর থানার পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় নির্মাণাধীন একটি দেয়াল থেকে ইট পড়ে নিহত হন এক গাড়িচালক। তার নাম দুলাল মিয়া (৪০)। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক।
তার মরদেহ উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে পুলিশ। মিরপুর মডেল থানার এসআই আসিকুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
কদমতলীর পলাশপুরে দেয়ালচাপা পড়ে মো. হাসান (৪০) নামে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন কদমতলী থানার ওসি জামালউদ্দীন মীর। তিনি জানান, পলাশপুর ৫ নম্বর সড়কে একটি বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেয়ালচাপা পড়ে তিনি মারা যান।
ঝড়ের মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবে এক নারী ও তার পাঁচ বছরের ছেলেসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- রুমি আক্তার, তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলে আরিফ হোসেন, তুহিন এবং সাব্বির হোসেন।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার এসআই রাসেল মোল্লা বলেন, কেরানীগঞ্জের মাদারীপুর ঘাট দিয়ে কামরাঙ্গীরচরে যাওয়ার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাটি। মুহূর্তেই সেটি ডুবে যায়। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
ঝড়ের সময়ে মগবাজারে আদ্-দ্বীন হাসপাতালের একটি দেয়াল ধসের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সদর দফতরের ডিউটি অফিসার আতাউর রহমান।
গুলশান-২-এর ১১৩ নম্বর রোডে প্রকৌশলী সালাউদ্দিনের গাড়ির ওপর গাছ ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে গাড়িটির সামনের কাচ ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। একই এলাকায় একটি সিএনজির ওপরও গাছ ভেঙে পড়ে বলে জানা গেছে।
ঝড়ের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, লালবাগ, বংশাল, আজিমপুর, শুক্রাবাদ, পান্থপথ, ধানমণ্ডি, কলাবাগান, মগবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায়। রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখাকালে অধিকাংশ এলাকা বিদ্যুৎবিহীন ছিল।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) এক কর্মকর্তা জানান, ঝড়ের কারণে কোনো কোনো এলাকার গ্রিড বিপর্যয় হয়েছে। তবে এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ জানান, রোববারের এই কালবৈশাখী ঢাকায় এবারের মৌসুমের প্রথম আঘাত। এর আগে অবশ্য সিলেটে ঝড় হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এদিন খুলনার কিছু এলাকা বাদে প্রায় সারা দেশেই কালবৈশাখী আঘাত হেনেছে।
এদিকে দিনের বিভিন্ন সময়ে ঢাকার বাইরে বিশেষ করে দেশের পূর্বাঞ্চলে কালবৈশাখী ও বজ্রপাত হয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে বজ্রপাতে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নিহত শিশুদের নাম সাদিয়া আক্তার (৬) ও মুন্নী আক্তার (৪)।
আবহাওয়াবিদরা জানান, সাধারণত ফেব্রুয়ারির শেষ থেকেই কালবৈশাখীর আনাগোনা চলে। তবে এবার এটা বিলম্বিত হয়ে মার্চের শেষদিন কালবৈশাখীর অভিষেক ঘটল। বাংলাদেশে এপ্রিল-মে এই দু’মাস কালবৈশাখীর মৌসুম।
বিএমডির এক সিনিয়র আবহাওয়াবিদ জানান, সন্ধ্যায় রাজধানীর ঝড় কমে গেলেও তা দেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলে যাচ্ছে। এটি কক্সবাজার পর্যন্ত যাবে। ফলে রাতে দক্ষিণাঞ্চলেও কালবৈশাখীর ছোবল পড়তে পারে।
বিএমডির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বাংলাদেশে অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে।
এতে বলা হয়, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে।
ঢাকা ছাড়াও বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় বয়ে যায় কালবৈশাখীর তাণ্ডব। কোথাও কোথাও বজ্রপাতও হয়। এর মধ্যে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় বজ্রপাতে দুই বোনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের নাম সাদিয়া আক্তার (৬) ও মুন্নী আক্তার (৪)।
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলা সদরে বজ্রপাতে রাব্বি মিয়া (১৮) নামে একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে রোকন মিয়া (২১) নামে একজন। নিহত রাব্বি মিয়া ইটনা সদরের নয়ানন্দী হাটি গ্রামের কাদির মিয়ার ছেলে। জানা যায়, ধনু নদীর বলদা ঘাটে স্টিল বডি নৌকা থেকে তীরে পাথর নামানোর কাজ করছিলেন তিনি।
রোববার দুপুর ১২টার দিকে দমকা হাওয়া ও বৃষ্টি শুরু হলে, শ্রমিকরা নিরাপদ আশ্রয়ে বাড়ির পথে রওনা হন। দাসপাড়া গ্রামের সামনের রাস্তায় পৌঁছলে বজ্রপাতে পড়েন তারা। এতে রাব্বি মিয়া ও একই গ্রামের রোকন মিয়া আহত হন। এলাকাবাসী তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকৎিসক রাব্বিকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত রোকন মিয়া হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার বাবার নাম শুক্কুর আলী। ইটনা থানার ওসি মুর্শেদ জামান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, রাব্বি’র মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলায় দুপুর ১টার দিকে বজ্রপাতে দেলোয়ার হোসেন (১৭) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। দেলোয়ার উপজেলার সদর ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের জুহুর মিয়ার ছেলে।
জামালগঞ্জ থানার ওসি আবুল হাসেম জানান, দেলোয়ার হোসেন বাড়ির পাশের হাওরে ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন। দুপুর ১টার সময় আকস্মিক বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। এ সময় বৃষ্টিও হচ্ছিল। দেলোয়ারের হোসেনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিকে দুপুরের পর থেকে জেলার বিভিন্ন হাওরে শিলাবৃষ্টি হওয়ায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
অপরদিকে, নেত্রকোনা সদর উপজেলার কচু ডোয়ারি এলাকায় বজ্রপাতে মো. আছর উদ্দিন নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় এ দুর্ঘটনা হয়। নিহত আছর উদ্দিন সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা।
নেত্রকোনা মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মানিকুল ইসলাম জানান, ঝড়ো বাতাসে শুরু হওয়া গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে ধান ক্ষেতে কাজ করছিলেন আছর উদ্দিন। এসময় বজ্রপাত হলে, আছরের পুরো শরীর ঝলসে যায়। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নেত্রকোনা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমনা আল-মজিদ জানান, বজ্রপাতে মারা যাওয়া বৃদ্ধের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে।