তারুণ্যদীপ্ত চেতনার আরেক নাম শহীদ রুমী
ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিশ্চয়ই অনেকেরই জানা। যুক্তরাষ্ট্রের সেরা পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। সেখানে পুরো ফান্ডের স্কলারশীপ পেতে কতোটা মেধাবী হতে হয় তা বলার অপেক্ষা নেই। রুমী এস.এস.সি পরীক্ষায় পুরো পাকিস্তানে তৃতীয় হয়েছিলেন ১৯৬৮ সালে। ১৯৭০ এ এইচ.এস.সি শেষ করে মাত্রই বুয়েটে ভর্তি হয়েছেন। বি.এন.সি.সি’র ক্যাডেট ছিলেন তিনি। হয়েছিলেন সার্জেন্ট। বুয়েটে ক্লাশ শুরু হয়নি তখনো। এরই মাঝে এলো ‘ইলিনয় ইউনিভার্সিটি’র সেই কাঙ্খিত চিঠি- ‘ডিয়ার শফী ইমাম রুমী, উই আর ডিলাইটেড টু অফার ইউ ফুল ফান্ডেড স্কলারশীপ এ্যাট আওয়ার ইউনিভার্সিটি’। সেটা রক্তঝরা ১৯৭১।
কি সুন্দর জীবনই না অপেক্ষা করছিলো রুমীর জন্য। ইলিনয়ের ডিগ্রী, তারপর বিশ্বসেরা চাকুরি, হয়তো সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে সুখের সংসার আর মা-বাবার কতোটা অহংকার। অথচ এই সবকিছু তিনি তুচ্ছ করে দিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্যে! বললেন ‘আগে দেশের স্বাধীনতা, পরে উচ্চশিক্ষায় যাত্রা’। পরিবারের অনেকেই হতাশ হলেন। বিশেষ করে আপন মামা তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একাধিক চিঠি লিখলেন ইংরেজীতে। ‘প্রিয় রুমী, তোমার বয়স মাত্র ২০। আগে নিজেকে তৈরি করো, পরে দেশের সেবা করো’। রুমীও ইংরেজীতে চিঠিগুলোর উত্তরে লিখলেন ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়, হে কে বাঁচিতে চায়’?
ভারতে গিয়ে গেরিলা ট্রেনিং নিলেন রুমী। মে মাসে ঢাকায় এসে গঠন করলেন ‘ক্র্যাক প্লাটুন’। বিশ্বের ইতিহাসে এমন দূর্দান্ত গেরিলা ইউনিটের উদাহরণ আর একটাও নেই। এর সব সদস্যই ছিলেন বয়সে তরুণ কিন্তু ভীষণ মেধাবী। সকলেই প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তান। দিনের পর দিন তারা এমন সব গেরিলা অপারেশন চালালেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ টাইপ অবস্থা। ‘ক্র্যাক প্লাটুনে’র নাম শুনলেই কাঁপতো পাকিস্তানী অফিসারেরা। মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর- পুরো ঢাকা কাঁপিয়ে রাখলো ‘ক্র্যাক প্লাটুন’।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা। রাজাকারদের কাছ থেকে ইনফরমেশন নিয়ে পাকিস্তানী সেনারা এই দলের সবাইকে আটক করে ফেললো। এরপর কি নির্মম অত্যাচার যে করলো তাদের উপর তার কোনো সীমা নেই। ক্র্যাক প্লাটুনের পরিবারের কাউকেও ছাড়লোনা নপুংশক পাকিস্তানীরা। তাদের মা-বাবা, ভাই-বোনের উপরও অমানবিক অত্যাচার চললো। রুমীর এক সহযোদ্ধা ছিলেন বদী। রুমী আর বদী সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে হলেও অন্যদের বাঁচাবেন। রুমী স্টেটমেন্ট দিলেন ‘ক্র্যাক প্লাটুনের হয়ে সকল অপারেশন চালিয়েছি আমি আর বদী’। পাকিস্তানীরা রুমী এবং বদী ছাড়া বাকীদের প্রাণে মারলোনা, অত্যাচার বন্ধ করলো। অন্যদের থেকে রুমী এবং বদীকে আলাদা করে নিলো চরম শাস্তির জন্য।
ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হবে রুমীকে। পাকিস্তানী জেনারেল ইয়াহিয়া খান রুমীর ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট দেখে চমকে উঠলো। জেনারেল খান অফার দিলো, যদি রুমীর মা-বাবা সন্তানের ভুল স্বীকার করে প্রাণ ভিক্ষা চান তবে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবেনা তাদের সন্তানকে। কিন্তু বাঘের বাচ্চা রুমীর মা-বাবা তাদের সন্তানের অপমানজনক জীবনের চেয়ে সম্মানজনক মৃত্যুই শ্রেয় বলে ভাবলেন। রুমীর বাবা ইঞ্জিনিয়ার শরীফ ইমাম এবং মা জাহানারা ইমাম কারাগারে গিয়ে কথা বললেন রুমীর সাথে। তার মতামত নিয়ে পাকিস্তানীদের সাফ জানিয়ে দিলেন ‘আমাদের সন্তান দেশের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধরে কোনো অন্যায় করেনি। ক্ষমা চাইবার প্রশ্নই আসেনা’। নিজ হাতে সন্তানকে শাহাদাতের পথে ঠেলে দেওয়াতে জাহানারা ইমামকে আমরা আজ ডাকি ‘শহীদ জননী’।
রুমীকে এরপর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে রুমীকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখে। বহু চেষ্টা করেও পরিবারের কেউ তার মরদেহ পর্যন্ত দেখতে পারেননি। এই দেশকে স্বাধীন করতে, আমাদের মুক্তির জন্য, মায়ের সম্মান রক্ষার জন্য যারা জীবন, যৌবন আর রক্ত দিয়ে এতোটা ত্যাগ স্বীকার করলেন- দূর্নীতি, রাজনৈতিক হানাহানি, খুনোখুনী আর নানারকম দূর্ঘটনায় নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে আমরা তাদের প্রতিদিন কি অপমানটাই না করছি! আমাদের কি কিছুটা লজ্জা হওয়া উচিৎ? ২৯ মার্চ, শহীদ শফী ইমাম রুমীর জন্মদিন। ১৯৫১ সালের এই দিনটিতে সিলেটের পবিত্র মাটিতে জন্মেছিলেন তিনি। তার স্মৃতির প্রতি মনের গভীর থেকে অফুরান শ্রদ্ধা। এমন মেধাবী আর সাহসী সন্তানের জন্ম হোক বাংলার প্রতিটি ঘরে।