১৪ ফেব্রুয়ারি: যে ইতিহাস মনে রাখেনি কেউ

১৪ ফেব্রুয়ারি, সারাবিশ্বের মতো ভালবাসা দিবসের আমেজে মেতে ওঠে বাঙালি জাতি। কিন্তু এই দিনটিতেই যে হৃদয়বিদারক এক ইতিহাস জড়িয়ে আছে সেটা আমরা কয়জনই বা মনে রেখেছি? ১৯৫২ সালে আমরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে ৩০ লাখ শহীদ। আর ১৯৮৩ সালের আজকের দিনে শিক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন জাফর, জয়নাল, আইয়ুব, কাঞ্চন, দীপালী সাহারা।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতায় আসেন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। দায়িত্ব গ্রহণ করেই এরশাদের প্রথম আক্রমণটা আসে শিক্ষার উপর। এরশাদের সুযোগ্য শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব পেশ করেন। ১ম শ্রেণী থেকেই আরবি ও ২য় শ্রেণী থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবিত ‘মজিদ খান শিক্ষানীতি’তে সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় ছিল উচ্চশিক্ষা। উচ্চশিক্ষা অর্জনের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয় মেধা অথবা পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা! । সাম্প্রদায়িকতা, শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ আর শিক্ষা সংকোচন-কে ভিত্তি ধরে প্রণিত এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়।

সারাদেশের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ এই নীতির  প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসেন। ১৯৮২ সালের ৮ নভেম্বর প্রথম নির্যাতন হয় আন্দোলনকারীদের উপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের লাঠিপেটায় গুরুতর আহত হন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নুরুল আমিন বেপারীসহ ছাত্র, কর্মচারী ও সাংবাদিক। ধীরে ধীরে আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। প্রবল প্রতিবাদের পরও ১৯৮৩’র জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাধ্যতামূলক আরবি শিক্ষা শুরুর আদেশ দেয়। ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে কড়া প্রেসনোট হুমকি দেয় এরশাদ। কিন্তু তাতেও ছাত্ররা পিছপা হয়নি।

সেসময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে ঘোষণা করা হয়, শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষায় অতিরিক্ত দুটি বিদেশী ভাষা বাধ্যতামূলক করে মূলত বাংলা ভাষাকেই আঘাত করা হয়েছে।

শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১১ জানুয়ারি প্রস্তাবিত তারিখে হাজার হাজার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে সমবেত হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল সচিবালয় ঘেরাও। তাদেরকে রুখতে অস্ত্রসজ্জিত প্রচুর দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ব্যাপক সংঘর্ষ এড়াতে সচিবালয়ে না গিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে আন্দোলন তীব্রতর করার শপথ গ্রহণ করে ছাত্ররা। শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। স্বৈরশাসক এরশাদ একুশের চেতনায় আঘাত হানতে শুরু করেন।

জানুয়ারির মধ্যভাগে আন্তর্জাতিক এক ইসলামী মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে এরশাদ বলেন,‘বাংলাদেশ মুসলমানদের দেশ, বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিলো শহীদ মিনার। কিন্তু আমরা দেখি সেখানে আল্পনা আঁকা হয়। এ কাজ ইসলামবিরোধী। শহীদ আবুল বরকত আল্লাহর বান্দা, তার জন্য আল্পনা কেন, কোরানখানি হবে।’

ধীরে ধীরে এরশাদ ও তার দোসর মজিদ খান ছাত্রদের রোষানলে পড়তে থাকেন। তারারাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টেডিয়াম উদ্বোধন করতে গেলে ছাত্ররা তা বর্জন করে। বাতিল হয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব।

১১ জানুয়ারির সচিবালয়ে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি রদবদল করার প্রতিবাদে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় ছাত্ররা। ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী মিছিলসহ স্মারকলিপি নিয়ে সচিবালয়ের দিকে এগিয়ে যায়। একাত্মতা ঘোষণা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও। তারাও এই আন্দোলনে অংশ নেয়।

ছাত্র-ছাত্রীরা হাইকোর্টের গেইট এবং কার্জন হল সংলগ্ন এলাকায় কাঁটাতারের সামনে এসে বসে পড়ে; নেতৃবৃন্দ কাঁটাতারের উপর দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ জানাতে থাকে। নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর পুলিশ শুধু লাঠি, টিয়ারগ্যাস, জলকামান ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হয়নি, গুলিও চালায়। গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একসময় ছাত্ররা শিশু একাডেমীতে আশ্রয় নেয়। সেখানে তখন শিশুদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিলো। অস্ত্রহাতে পুলিশ সেখানেও ঢুকে পড়ে। এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর হাত থেকে সেদিন কোমলমতি শিশুরাও রক্ষা পায়নি।

প্রায় সারাদিনব্যাপী এই অসম সংঘর্ষে নিহত হন জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা, আইয়ুব, ফারুক, কাঞ্চন প্রমুখ। কিন্তু তাদের লাশও গুম করে ফেলা হয়। ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, কিন্তু সরকারি প্রেসনোটে ১ জনের মৃত্যুর কথা দাবী করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে সরকার ও ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়।

আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সারাদেশে ১৪ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক গ্রেফতার অভিযান চলে। শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, রাশেদ খান মেনন, তোফায়েল আহমেদসহ শীর্ষস্থানীয় অনেক ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে এরশাদ বাহিনী। তবে আন্দোলন থামাতে পারেননি। এর চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৯০ সালে। পতন ঘটে স্বৈরশাসক এরশাদের।

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের এমন হৃদয়বিদারক ও সংগ্রামী ইতিহাস ঢেকে যায় শফিক রেহমান নামক একজন সাংবাদিকের হাত ধরে, ১৯৯৩ সালে। আমাদের দৃষ্টি ধীরে ধীরে ঘুরে যায় অন্যদিকে। নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসে ইতিহাসের কালো অধ্যায়। শুরু হয় ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ পালন উৎসব। জাফর, জয়নাল, দিপালীর জন্য আমাদের কারো মনে কোন ভালোবাসা থাকে না। মাঝে মাঝে কেউ হয়তো স্মৃতি হাতড়ায়….। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমাদের শিক্ষাকে সুগঠিত করতে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে যারা প্রাণ দিলো তারা হারিয়ে যায় ভালোবাসা দিবসের কাছে। আমরা ‘হুজুগে’ বাঙালি জাফর জয়নাল দিপালীদের ভুলে ভালোবাসা দিবস পালনে মেতে উঠি!

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)