একাত্তরের নির্মমতার সাক্ষী পাটকেলঘাটার ডাকবাংলো ও পারকুমিরার বধ্যভূমি
পাটকেলঘাটা ডাকবাংলোটি ছিল রাজাকারদের ক্যাম্প । যা ছিল সাধারণ মানুষ ও মুক্তি যোদ্ধাদের নির্যাতন কেন্দ্র । এখানে নারীদের ধরে এনে অস্বাভাবিক নির্যাতন করা হতো । প্রথমে পাশবিক নির্যাতন পরে গুলি করে হত্যা । সে সময় ডাকবাংলোটিতে এক জন কসাই থাকতেন। কসাই রাতে কপোতাক্ষের পাটাতনে শহীদদের মৃত দেহ থেকে মুন্ডু আলাদা করে নদের জলে ফেলে দিত । মে জুন থেকে শুরু হয়ে এভাবে প্রতি রাতে ১৫ থেকে ২০ জন মানুষকে ডিসেম্বরের মুক্তির আগ পর্যন্ত মারা হয় ।
তালা থানার শান্তির কমিটির প্রধান অ্যাডভোকেট শেখ আনসার আলী ও পাটকেলঘাটা ক্যাম্পের রাজাকার কমান্ডার ইয়াকুবের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিশাল এক রাজাকার বাহিনী । যাদের হাত থেকে এলাকার সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী , শিক্ষক , চিকিৎসক এমন কী নারী-শিশু কেউ রেহায় পাইনি ।
১৯৭১সালের ২৩এপ্রিল জুমার নামাজের দিন । দোকান বন্ধ করে বাড়িতে ফেরার জন্য সকলেই ব্যস্ত । এমন সময় মিলিটারি আসার একটি সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
দেশে তখন চলছে মুসলিম লীগ , জামাত ও শান্তি কমিটির লোকজনের অমানুষিক নির্যাতন । এ অত্যাচারে হাজার হাজার মানুষ ভিটে মাটি ত্যাগ করে ভারতের উদ্দেশ্যে ছুটছে বাঁচার জন্য । যাত্রা পথেও রাজাকার দের কাছে লুট হচ্ছে সাধারণ মানুষের সহায়, সম্বল , নারীর ইজ্জত। কেউ আবার খুন হয়ে পড়ে থাকছে রাস্তার ধারে । শকুনে ছিঁড়ে খাচ্ছে তাদের মাংস।
এমনি ভাবে বাড়ি ও গ্রাম ত্যাগ করে বহুলোক ভারতের পথে রওয়ানা হয়ে পাটকেলঘাটা ব্রিজের কাছাকাছি কুমিরা স্কুল ও গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেয় । সামান্য বিশ্রাম ও চিড়ে মুড়ি খাওয়ার পর আবার শুরু হবে তাদের যাত্রা।
এমন সময় চারিদিকে দৌড়াদৌড়ি, হৈচৈ কী ব্যাপার, কি হলো ?
সাতক্ষীরা থেকে মিলেটারী এসে ঘিরে ফেলেছে পাটকেলঘাটা বাজার । তাদের সামনে দেখা যাচ্ছে মনু কসাই । সেই জেনো মিলেটারীর কমান্ডার । তার হুকুমেই চলছে মিলেটারী সৈন্য ।
ইতিমধ্যে ধরে আনা হলো এলাকার বাছাই করা ব্যবসায়ী ও শরণার্থীদের । গরুর দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হলো সবাইকে। কেড়ে নেওয়া হলো কাছে থাকা টাকা, ঘড়ি,চশমা,আংটি ও অন্য অন্য সব জিনিস । এর পর চললো অমানুষিক নির্যাতন । বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হলো কয়েক জনকে । শেষে চললো ব্রাশ ফায়ার । মারা যাবার আগ পর্যন্ত নিরিহ এসব মানুষের ব্যথা , যন্ত্রণার চিৎকার আকাশ বাতাসকে কাপিয়ে তুলল ।
শুধু কাপলো না মনু কসাই আর মিলেটারীর বুক। পাশবিক আনন্দে মেতে উঠলো হায়নারা ।
মনু কসাই সম্পর্কে যতটুকু জানাজায়, সে এক জন অবাঙ্গালী, ভারতের বিহার থেকে পাটকেঘাটা বাজারে এসেছে কসাই এর ব্যবসা করতে ।
স্বাধীনতার পর এ ক্যাম্পের কয়েক জন রাজাকার কমান্ডারকে হত্যা করা হলেও, রাজাকার কমান্ডার ইয়াকুব পালিয়ে যেতে সম্ভব হয় । কয়েক বছর পর সে আবার গ্রামে ফিরে আসে । এবং যোগদেয় জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে ।
সেদিনের সেই হত্যা যজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী মৃত কার্তিক চন্দ্র দে এর স্ত্রী চপলা রানি দে (৭৫), শেখ নেছার আলীর স্ত্রী কুলসুম বিবি (৬০), কানাই লালের ছেলে বিশ্বনাথ রায় (৫৮) এবং শহীদ পরিবারের সন্তান শেখ নুরুল ইসলাম সেদিনের সেই বরর্বর হত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘সেদিন ছিল শুক্রবার। মসজিদে জুম্মার আযান হচ্ছিল এ সময় পাটকেলঘাটা থেকে পাকিস্তানী হায়নারা বীর দর্পে পারকুমিরায় গিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীকে আলোচনার কথা বলে একত্রিত করে। লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সহজ সরল গ্রামবাসীর উপর ব্রাশ ফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই ৭৯জন নিহত হয়’।
এছাড়া রাজাকার কমান্ডার ইয়াকুবের নেতৃতে নোয়াকাটি গ্রাম ও তালা থানার জালালপুরের শত শত বসত বাড়িতে অগ্নি সংযোগ, লুটপাট , ও কয়েক শত মানুষ কে গুলি করে হত্যার করে।
এর মধ্যে ৪৯জনের লাশ পারকুমিরার বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। স্বাধীনতার পর একে একে ৪৬টি বছর অতিবাহিত হলেও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় সেখানে বিভিন্ন মৌসুমে ফসলের আবাদ হয়।
সে দিনের এক শহীদের সন্তান অশোক পাল বলেন , হায়েনারা যাদের প্রকাশ্য গুলি ও ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেছে তাদের স্মৃতিস্তম্ভ (বধ্যভূমি) আজ অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কর্তৃপক্ষের তেমন কোন দৃষ্টি নেই এই বধ্যভূমির দিকে। দীর্ঘ ৪৬বছর পরও পাকহানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের সাক্ষ্য বহনকারী পাটকেলঘাটা থানার পারকুমিরার এই বধ্যভূমি টি সংরক্ষণের কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি এখনও পর্যন্ত।
শহীদের সন্তান টিপু সুলতান বলেন , প্রতি বছর ২৩ এপ্রিল শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন দলীয় ভাবে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। কিন্তু খোঁজখবর নেওয়া হয়না শহীদ পরিবারের। বিশেষ এই দিনটি ছাড়া বাকি দিন গুলি গণকবরের বুকে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ হয়ে থাকে। বর্তমানে সেখানে সরিষার ক্ষেত।
তালা উপাজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার মোঃ মফিজউদ্দিন বলেন , শহীদ পরিবার সহ সর্বমহলের সরকারের কাছে একটাই চাওয়া যেহেতু প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই স্থানে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে ছিলেন, সেহেতু তার উদ্যোগে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে এই বধ্যভূমি রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হোক। মৃত শহীদ পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে আর্থিক দুরবস্থার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে । তাদের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।