আর্কিমিডিসের ‘ইউরেকা’র প্রকৃত গল্প

‘ইউরেকা’ অর্থ ‘পেয়েছি’। এই শব্দটি নিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের গল্পটি সকলেরই হয়তো জানা!কেউ কেউ আবার বাস্তব জীবনে কোনো বিষয়ের সমাধান দাঁড় করাতে পারলে নিজেরাই নিজেদের বাহবা দেই ইউরেকা বলে! আর্কিমিডিসের ইউরেকার প্রচলিত গল্পটি এরকম-

খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় তিনশত বছর পূর্বে, তৎকালীন সিসিলিয়ান নগরী সিরাক্যিউজ এর রাজা হাইরন তার সভার প্রধান বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের পান্ডিত্য যাচাই করতে চাইলেন। তিনি হুবহু একই রকম দেখতে দু’টি সোনার মুকুট বানালেন, যেটির একটি ছিলো শুধু খাঁটি সোনায় নির্মিত, অন্যটি ছিলো খাদে পরিপূর্ণ। রাজা হাইরন মুকুট দু’টি আর্কিমিডিসের সামনে পেশ করে হুকুম দিলেন, মুকুট দু’টিকে না ভেঙে বা বাহ্যিক কোনো পরিবর্তন না করে সোনার মুকুটটি বেছে নিতে। আর যদি আর্কিমিডিস তা না পারেন, তবে তার গর্দান যাবে! বেচারা আর্কিমিডিস তখন পড়লেন মহাবিপদে! প্রাণভয়ে তার মুখ শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে রইলো।

তারপর একদিন দুপুরবেলা উলঙ্গ শরীরে চৌবাচ্চায় গোসল করতে নামতে গিয়ে দেখলেন, চৌবাচ্চাটি পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ, কিন্তু তিনি নামার পরে সেটি থেকে বেশ খানিকটা পানি উপচে পড়েছে। সেই মুহূর্তেই আর্কিমিডিস প্লবতা আবিষ্কার করলেন, খুঁজে পেলেন তার মুকুট সমস্যার সমাধান। তিনি যে উলঙ্গ, সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার দিতে দিতে দিলেন ছুট রাজদরবারে। এসে এক নিশ্বাসে রাজাকে বলতে লাগলেন, ‘ অন্য একটি খাঁটি সোনার মুকুট আমাকে দিলেই আমি এ দু’টোর মধ্যে কোনটি খাদ তা বের করতে পারবো।’ কিন্তু আসল গল্পটি কি এরকম? ইতিহাস কি বলে? না, আসল ঘটনা মোটেই এরকম নয়!

রাজা হাইরন মূলত আর্কিমিডিসকে সে যুগের নজিরবিহীন একটি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্ট তদারকির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এ প্রকল্পকে সামনে রেখে হাইরন বানালেন বিশাল এক জাহাজ। সেকালের সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজের তুলনায়ও এটি ছিলো প্রায় ৫০ গুণ বড়! সিরাক্যিউজ শহরের নামে জাহাজটির নাম দেয়া হয় ‘সিরাকুসিয়া’। সর্বকালের সবচেয়ে বড় এ জাহাজ হাইরন বানাচ্ছিলেন তৎকালীন মিশরের শাসনকর্তা টলেমিকে উপহার দেয়ার জন্য। কিন্তু এ জাহাজ তৈরির প্রকল্প নিয়ে একটি ভাবনাই রাজা হাইরনের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে যাচ্ছিলো ক্রমাগত। প্রাসাদোপম একটি জাহাজ কি সত্যিই পানির উপর ভেসে থাকতে পারবে? আর্কিমিডিসের সময়কালে কেউ এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সাহসও করে নি। তাই জাহাজটি সত্যিই পানিতে ভাসবে কি না, এ নিয়ে ছিলো ঘোর অনিশ্চয়তা! এটি ছিলো তখনকার দিনে ‘একটি পাহাড়ের পক্ষে কি ওড়া সম্ভব?’

এই প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো জটিল একটি ব্যাপার। শত শত শ্রমিকের বহু বছরের সাধনায় তৈরি হয়েছিলো সিরাকুসিয়া। পর্বতের বিশেষ দেবদারু গাছের তক্তা, স্পেনে উৎপন্ন শনের দড়ি, ও ফ্রান্সের আলকাতরা ব্যবহৃত হয়েছিলো জাহাজ তৈরিতে। জাহাজটির বাইরের ডেকে ছিলো মোট আটটি ওয়াচটাওয়ার। এছাড়াও জাহাজের সম্মুখভাগে বসানো হয় বিশালাকৃতির ধনুক, যা দিয়ে ১৮০ পাউন্ড ওজনের পাথর ছুঁড়ে মারা সম্ভব ছিলো। এছাড়াও আধুনিক যুগের প্রমোদতরীগুলোর মতো সিরাকুসিয়াতেও ছিলো লাইব্রেরি, উষ্ণ পানির সুইমিং পুল, উপাসনালয়, জিমনেশিয়ামসহ আরো অনেক সুযোগ সুবিধা!এখানেই শেষ নয়! হাইরন চাইলেন, তার জাহাজটি বহন করবে ৪০০ টন খাদ্যশস্য, ১০ হাজার সামুদ্রিক মাছের জার, ৭৪ টন সুপেয় পানি ও ৬০০ টন পশম। যাত্রী হিসেবে জাহাজে থাকবেন এক হাজার মানুষ, এদের মধ্যে ৬০০ জন সৈন্য, ২০ টি ঘোড়া। অভিষেক যাত্রার জন্য এই ছিলো রাজা হাইরনের ইচ্ছা!

এই অসম্ভবকে সম্ভব করার দায়িত্ব পড়ল আর্কিমিডিসের উপর। রাজার ইচ্ছার উপর না বলার কোনো সুযোগ ছিলো না তার। তাই ভালোয় ভালোয় সমস্যাটি নিয়ে চিন্তা শুরু করলেন আর্কিমিডিস, জাহাজটি কি ভাসবে? এমনি সময় একদিন বাথটাবে গোসল করতে গিয়ে ঘটল সেই যুগান্তকারী ঘটনা। আর্কিমিডিস আবিষ্কার করলেন তরল পদার্থের প্লবতার নীতি, ইঞ্জিনিয়ারিং এর পড়াশোনায় আজো যেটি আর্কিমিডিসের নীতি হিসেবে পড়ানো হয়। সহজ কথায় সূত্রটি এমন- একটি বস্তু তখনই ভাসবে যখন এটি তার ওজনের সমপরিমাণ অথবা তার থেকে বেশি তরল অপসারণ করতে পারবে। যেমন, ২ হাজার টন ওজনের সিরাকুসিয়াকে তখনই ভাসানো যাবে, যখন এটি পানিতে নামলে এর আয়তন দ্বারা ২ হাজার টন ওজনের পানি অপসারণ করতে পারবে, তবে ভাসলেও সেটি থাকবে নিমজ্জিত অবস্থায়। আর্কিমিডিসের সূত্র বলে, ২ হাজার টন ওজনের জাহাজটি যদি ৪ হাজার টন পানি অপসারণ করতে সক্ষম হয়, তবে এটি নিমজ্জিত অবস্থায় নয়; বরং পরিপূর্ণ উপায়ে ভাসতে সক্ষম হবে। আর যদি জাহাজ দ্বারা অপসারিত পানির ওজনের পরিমাণ হয় জাহাজের তুলনায় কম, তবে সেটি ডুবে যাবে।

চৌবাচ্চায় বসে এমন যুগান্তকারী আবিষ্কারেই উত্তেজিত হয়ে আর্কিমিডিস ইউরেকা! ইউরেকা! বলে ছুটে যান রাজদরবারে। তবে মুকুটের গল্পটিও যে মিথ্যা এমন বলার সুযোগ নেই। এমনো হতে পারে, আর্কিমিডিস তার নীতির পরীক্ষা মুকুট দিয়েই করেছিলেন, অতঃপর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তবে ইউরেকার পেছনে সত্যিকারের ঘটনা কিন্তু ছিলো সিরাকুসিয়া জাহাজটিকে ঘিরেই; যেটি আর্কিমিডিসের আবিষ্কৃত সূত্রের ওপর ভিত্তি করে শেষ পর্যন্ত সব মালামাল ও মানুষদের নিয়ে মিশর পৌঁছাতে সক্ষম হয়!

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)