শার্শা উপজলোর বিভিন্ন সীমান্তে ১০ হাজার নারী পাট ‘ধোয়ার’ কাজে ব্যস্ত

লতি পাট মৌসুমে শার্শার উপজেলার পাট কাটা, জাগ দেওয়া ও পাটকাঠি থেকে পাট ছাড়ানো শুরু হয়েছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় সময় মতো পাট কেটে তা বিভিন্ন জলাশয়ে জাগ দিতে পেরেছেন কৃষকরা।শার্শা উপজেলার বারোপোতা গ্রামের মরিয়ম বেগম, রিজিয়া খাতুন, রাফিজা বেগম, শার্শা উপজেলার টেংরা গ্রামের আছিয়া বেগম, তছলিমা খাতুন, রাহিমা খাতুন, খাদেজা খাতুন, আকলিমা খাতুন, খুকি বেগম আর সামটা গ্রামের ছায়রা খাতুন, খাদিজা খাতুন, দেউলির অমেনার এখন দম ফেলার সময় নেই। পাট ধোয়া আর আঁশ ছাড়ানোর কাজে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত তারা। গত কয়েক বছর আবহাওয়ার প্রতিকূলের কারণে এ অঞ্চলে পাট চাষ তেমন একটা ভাল হয়নি। এবার নতুন আশায় সোনালি আঁশ খ্যাত পাট চাষে বাম্পার ফলন পেয়ে নারীরাও ঘরে বসে নেই। বিভিন্ন বয়সের নারীরা পাটের বোঝা বেঁধে পানিতে জাগ দেওয়া থেকে শুরু করে আঁশ ছাড়ানো পর্যন্ত পুরুষের সঙ্গে সমান তালে জীবিকা নির্বাহ করছেন। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় সময় মতো পাট কেটে তা বিভিন্ন জলাশয়ে জাগ দিতে পারায় কৃষকরা এখন সোনালী আাঁশের সোনালী স্বপ্নে বিভোর। গ্রামে বসবাসরত অধিকাংশ নিতান্ত গরিব নারীরা সোনালি পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
চলতি মৌসুমে শার্শার পাট কাটা, জাগ দেওয়া ও পাটকাঠি থেকে পাট ছাড়ানো এখন উৎসবের আমেজ পেয়েছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে শার্শায় পাট কাটা, জাগ দেওয়া ও পাটকাঠি থেকে আঁশ ছাড়ানোর কাজে অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ১০ হাজার নারী। পুরুষদের পাশাপাশি এই কাজে অংশ নিয়ে কিছুটা বাড়তি আয়ের মুখ দেখছেন তারা।
শার্শার উপজেলার উত্তর বারোপোতা গ্রামের মোরিয়ম বেগম জানান, এক আঁটি পাট ছাড়ালে পাওয়া যায় ৩০ টাকা। একজন নারী দিনে ২০ থেকে ৩০ আঁটি পাটের আঁশ ছাড়াতে পারেন। অন্য সময় ক্ষেতমজুর হিসেবে কাজ করলে যে টাকা মেলে, পাট ধোয়ার কাজে পাওয়া যায় তার তিনগুণ বেশি টাকা। এ কারণেই সংসারের কাজের পাশাপাশি পাট মৌসুমে পাট ছাড়ানোর কাজে যোগ দিচ্ছেন নারীরা। অনেকে আবার কাজটি করছেন পাটকাঠি নেয়ার শর্তে। এতে সংসারের ব্যয় নির্বাহে কিছুটা হলেও সহযোগিতা করতে পারছেন তারা।
শার্শা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ হীরক কুমার সরকার জানান, উপজেলায় দুই হাজার নারী নিজের জমিতে চাষাবাদ করেন। অন্যের জমিতে মজুর হিসেবে কাজ করেন আরো প্রায় চার হাজার নারী। “তবে মৌসুমে পাটকাঠি থেকে পাট ছাড়ানোর কাজ করেন এ জনপদের প্রায় ১০ হাজার নারী।” এবার উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম জমিতে পাট চাষ হয়েছে। শার্শায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। বিপরীতে চাষ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে।” গতবার পাটের মূল্য কম পাওয়ায় চাষিরা এবার পাট চাষ কম করেছে বলে তিনি জানান।
সামটা গ্রামের ছায়রা খাতুন তার জীবনের দীর্ঘ সংগ্রামের গল্পে জানান, অল্প বয়সে বিয়ে হয় আমার। স্বামী ছিলেন পাশের গ্রামেরই এক কৃষকের ছেলে। পৈতৃক পেশাতেই ছিল আমার স্বামীর। অভাবের তাড়নায় সামান্য কৃষিজমি বিক্রি করে বিদেশে যান তিনি। বর্তমানে আমার কোন খোঁজখবর নেয় না স্বামী। আমার চার ছেলে-মেয়ের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে এবং পড়াশোনার খরচ জোগাতে পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাজ নিজেকে নিয়োজিত করি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাটের আঁশ ছাড়িয়ে প্রতিদিন আয় করি ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। এ রোজগারের টাকা দিয়ে আমার সংসার ভালোভাবেই চলে যায়। শুধু গ্রামের কয়েকশ’ পরিবারের নারীরা পাটের আঁশ ছাড়িয়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।
দেউলির অমেলা ক্ষোভের সাথে জানান, স্বামী মারা গেছে ১০ বছর আগে। মাঠে কাজ করে সংসার ও ছেলেমেয়েদের মানুষ করছি। পাটের মৌসুমে পাটের আশ ছাড়ানোর কাজ করে ৩ ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করাই। পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করেও আমরা নারীরা ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছি না। আমাদের পক্ষে কেউ এ ব্যাপারে কিছু বলে না।
টেংরা গ্রামের আছিয়া বেগম জানান, স্বামী মাঠে কাজ করে। সংসারে একটু সচ্ছলতা আনতে ঘরে না বসে থেকে এ কাজ করে সংসারে কিছুটা সহযোগিতা করছি। এ টাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও কাপড় চোপড় হয়ে যাবে।
শ্রাবণ থেকে ভাদ্র মাসের মাঝা-মাঝি সময়ে পাট কেটে ১০ থেকে ১৫ দিন পানির নিচে ডুবিয়ে রেখে নিখুঁত হাতে নারীরা পচা পাট থেকে আঁশ ও আলাদা করেন। পাট গাছের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এই আঁশই সবচেয়ে মূল্যবান। প্রতি মণ পাট এবার ১২শ‘ থেকে ১৫শ‘ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু পাট চাষে নিয়োজিত নারী শ্রমিকরা বিরাট অবদান রাখলেও অধিকাংশ নারী শ্রমিক ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না। নারীরা পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরি পাচ্ছেন তাদের চেয়ে কম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাটের আঁশ ছাড়িয়ে একজন পুরুষ মজুরি পান ৩৮০ থেকে ৪১০ টাকা আর নারী শ্রমিক পান ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। তারপরও তারা থেমে নেই। নারীরা পরিবার ও সমাজের উন্নয়নে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ভাগ্যোন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)