ছন্নছাড়া দলটিই মাশরাফি ম্যাজিকে আবার ‘টিম বাংলাদেশ’

‘তবে কি তিনি জাদু জানেন? তার হাতে কি তাহলে আলাদিনের চেরাগ আছে, কিংবা এমন কোনো জাদুর কাঠি? যার পরশে বদলে যায় একটি দলের পুরো চালচিত্র, চেহারা। নাহ, জাদু জানবেন কি করে? তিনি তো আর জাদুকর নন। ক্রিকেটার। সখেও জাদু-টাদু দেখান- শুনিনি কখনো। তাহলে, কেন তার স্পর্শে বারবার টিম বাংলাদেশের চেহারা বদলে যায়? এর রহস্যই বা কি?’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক অনুজ প্রতিমের স্ট্যাটাস! সত্যিই তাকে নিয়ে এখন কত কথা! নানা প্রশ্ন। রাজ্যের কৌতুহল। তিনি কি শুধুই একজন মানুষ কিংবা একজন ক্রিকেটার? মূলতঃ তিনি তো একজন পেস বোলার। যার নিচের দিকে একটু আধটু ব্যাট করার ক্ষমতাও আছে। সে সঙ্গে তার আরও একটি বড় পরিচায়, তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক।

ব্যাস এইটুকুতেই কি শেষ? না নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ে বেড়ে ওঠা ৩৪ বছরের সাহসী, উচ্ছল, প্রাণখোলা, সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত অথচ বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী মাশরাফি বিন মর্তুজার কি আর কোন পরিচয় নেই?

আছে। ক্রিকেটার মাশরাফির চেয়ে বড়, অধিনায়ক মাশরাফি। আর অধিনায়ক মাশরাফি ছাপিয়ে বড় ‘মানুষ মাশরাফি’। তাইতো ‘মাশরাফি মানেই অনুপ্রেরনা। মাশরাফি মানেই উদ্দীপনা। মাশরাফি মানেই সহযোগিদের জন্য অফুরন্ত সাহস, আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার অন্যতম মাধ্যম।’

এর বাইরেও মাশরাফিকে নিয়ে আরও অনেক কথাই বলার আছে। তিনি এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘মহীরুহ’। ক্রিকেটারদের ভাই। অভিভাবক। সবচেয়ে বড় নির্ভরতা। আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। তারপরও ওপরে এতক্ষণ যে কথাগুলো বলা হলো এর কোনটাই যে একদম নতুন কোনো কথা, কেউ আগে কখনো শোনেনি- এমন নয়। পুরনো ও জানা কথা-বার্তা। তবে রোববার রাতে সেই পুরনো কথা এবং জানা বিষয়টি আবার নতুন করে লিখতে হলো। ‘অধিনায়ক মাশরাফির’ ছোঁয়ায় দেখা মিললো চিরচেনা সেই ‘টিম বাংলাদেশে’র।

এই তো ক’দিন আগে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টেস্টে যে দলটিকে মনে হয়েছে আড়ষ্ট, দূর্বল-ভাঙ্গাচোরা ও ছন্নছাড়া। সেই দলটিই রোববার রাতে গায়ানার প্রোভিডেন্সে একদম অন্যরকম। নির্ভীক, সাহসী, উদ্যমী। ভাল খেলায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।

তারপরও সমালোচকরা হয়ত বলবেন, মাঝে-মধ্যে একে ওকে হারালেও টেস্টে বাংলাদেশ কখনোই ভাল দল নয়। দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে টাইগাররা বরাবরই জুবুথুবু। অনুজ্জ্বল। আর ওয়ানডেতে সেই দলেরই ভিন্ন চেহারা! বেশ কিছুদিন ধরেই ৫০ ওভারের ফরম্যাটে মোটামুটি ভাল দলের তকমা গায়ে আঁটা। একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট হয়ে গেছে নিজেদের নামের পাশে।

সেখানে অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির অবশ্যই একটা বড় ভূমিকা আছে। অবদানও আছে। তাই বলে, তার কারণেই একদিনের ম্যাচে বাংলাদেশ ভাল দল, তার স্পর্শেই ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং- তিন শাখাতেই উজ্জ্বল- তা মানতে আপত্তি কারো কারো।

সমালোচকরা তথা মাশরাফি বিরোধীরা যাই ভাবুন না কেন, সত্যিই মাশরাফির শারীরিক উপস্থিতি পাল্টে দেয় বাংলাদেশ দলকে। মাশরাফির উপস্থিতিতে বদলে যায় পুরো একটি দল। শরীরি ভাষাটাই বদলে যায়, হয়ে ওঠে অন্যরকম। বোঝাই যায়, সবাই চাঙ্গা। ফুরফুরে মেজাজে। নির্ভার। ভাল খেলতে এবং জিততে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

তার প্রামাণ্য দলিল, রোববার রাতে গায়নার প্রোভিডেন্সে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ওয়ানডের ট্র্যাক রেকর্ড যতই তুলনামূলক সমৃদ্ধ থাক না কেন, কঠিন সত্য হলো- একটা সফরে কোন ফরম্যাটের সিরিজে খুব বেশি খারাপ খেলে ফেললে সেই খারাপের ধাক্কা সামলে ওঠা কঠিন।

এমন অনেক নজির আছে। অনেক ভালো ভালো দলও কোন ভিনদেশে গিয়ে একটি সিরিজ হারের পর অন্য ফরম্যাটেও খারাপ খেলতে শুরু করে। মূল কারণ আস্থা, আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে। সামর্থ্যের প্রতি আস্থা কমে যায়। নিজের ওপরও বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়।

বাংলাদেশ দল টেস্টে চরম খারাপ খেলেছে। তার প্রভাবে ওয়ানডে সিরিজে ভাল না খেলাও ছিল স্বাভাবিক; কিন্তু সেটা হয়নি মাশরাফির উপস্থিতির কারণেই।

দেশ ছাড়ার আগে ওয়ানডে সিরিজ নিয়ে বড় গলায় কিছু বলতে রাজি হননি। জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়ে শুধু বলেছিলেন, এখনই ওয়ানডে সিরিজ নিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চাই না। আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গিয়ে পৌঁছাই! নতুন কোচ। ক্রিকেটারদের সাথে বসি। পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবো।’

দীর্ঘ প্রায় দুই দিনের বিমান ভ্রমণ শেষে দলের সাথে যোগ দেয়ার পর সাকুল্যে দুটি প্র্যাকটিস সেশন পেয়েছেন মাশরাফি। হয়ত দুই কি তিন দফা টিম মিটিং করার ফুরসত মিলেছে। দেখেন, তাতেই বদলে গেছে পুরো দলের শরীরি ভাষা। টেস্টের সেই ছন্নছাড়া, জুবুথুবু ভাব নেই। সবাই অনেক বেশি চাঙ্গা; ফুরফুরে।

টেস্টে পারিনি। ঘরের মাঠে সেই ওয়ানডে সিরিজটিও ভাল কাটেনি। এবার কিছু একটা করতেই হবে। ভাল খেলতে হবে। আমাদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হবে- এই মন্ত্রে পুরো দল দীক্ষিত হয়েছে মাশরাফির দাওয়াইয়ে। আর তাই মাঠে নেমে দ্বিতীয় ওভারে উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গার পরও তামিম-সাকিব অনেক বেশি দায়িত্ব সচেতন। স্বভাবসূলভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং ছেড়ে ও দারুণ হিসেবি ব্যাটিং করলেন। সাথে মুশফিকুর রহীমের ১০ বলে ৩০ রানের ছোট্ট কিন্তু হ্যারিকেন ইনিংস। ওই তিনের যোগফল ২৭৯ রানের বড়সড় পুঁজি। স্লো উইকেটে যা রীতিমত বড় স্কোর।

এরপর মাশরাফির অসাধারণ বোলিং। ৩৭ রানে ৪ উইকেট শিকার। খালি চোখে এটুকুই? নাহ! এর বাইরে অধিনায়ক মাশরাফির আরও ক্যারিশমা আছে। টস জিতে আগে ব্যাট বেছে নেয়া থেকে শুরু করে ব্যাটিং অর্ডার সাজানো এবং বোলিং পরিচালনা- সবই ছিল নিখূঁত, নিপুন।

প্রোভিডেন্সের পিচে আগে ব্যাট করা দলের গড়পড়তা স্কোর ২৩২। আর পরে ব্যাট করা দলের গড় রান ১৯৫। তার মানে পিচ শুরু থেকেই স্লো। সময় গড়ানোর সাথে সাথে আরও স্লথ হয়ে যায় উইকেট। এমন উইকেটে আগে ব্যাট করার চেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ আর নেই। তাই করেছেন মাশরাফি।

যা দেখে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। আরে করলেন কি? টেস্টে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ৪৩ রানে ইনিংস শেষ হয়েছিল। এবার ওয়ানডেতেও আগে ভাগে ব্যাটিং। এবারো না জানি কি হয়? কারো কারো মনে এমন সংশয়-সন্দেহের বীজ কিন্তু ছিল। সাহসী ও ইতিবাচক মানসিকতার মাশরাফি সে সংশয়মুক্ত হয়ে প্রথম ব্যাটিং বেছে নিয়ে সাফল্যের পথে প্রথম পা রাখেন।

এরপর সাকিবকে ওয়ান ডাউনে খেলানোর সিদ্ধান্ত বহাল রাখা। ঘরের মাঠে তিনজাতি আসরে সাকিবকে তিন নম্বরে প্রমোশন দেয়ার সিদ্ধান্তটিও তার। সেই আসরের ফাইনালে সাকিবের ব্যাট করা হয়নি ইনজুরির কারণে। কাল সেই সাকিবকে ঠিক ওই ওয়ানডাউনে খেলানোও ছিল দুরদর্শী সিদ্ধান্ত। সাকিব মরিয়া ছিলেন নিজেকে মেলে ধরতে।

এরপর নিজে বোলিং ওপেন করা আর সাথে গেইলের কারণে অফস্পিনার মিরাজকে ওপেনিং বোলিং পার্টনার হিসেবে ব্যবহার করাতেও মিলেছে ক্রিকেট বুদ্ধির ছাপ। গেইল যতক্ষণ ছিলেন, ততক্ষণ আরেক অফ স্পিনার মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে দিয়েও দারুণ বাজি খেলেছেন মাশরাফি। গেইল থাকা অবস্থায় সাকিব, মোস্তাফিজের মত বোলারকে মাশরাফি ব্যবহার করেননি।

তার বোলিং পরিচালনা, ফিল্ডিং সাজানো এবেং দল পরিচালনা- সবই ছিল খুবই উঁচুমানের। যে মানের কারণেই আসলে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। সব মিলে মাশরাফি ‘থেরাপি’ বদলে দিয়েছে পুরো একটি দলকে। ছন্নছাড়া টাইগাররা আবার এক সুঁতোয় গাথা কযেকটি গোলাপ, একতাবদ্ধ। আবার ‘টিম বাংলাদেশ’।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)