সন্তানের চোখের জলে কোর্টে এক হলেন বাবা-মা

কোথায় আইন! কোথায় আদালত! বিবেকের আদালতে সব যেন ফিকে হয়ে গেল। সন্তানের চোখের জলে ভেসে গেল সকল বিধান। জয় হলো ভালোবাসার। জয় হলো সামাজিক বন্ধনের।

এদিন আদালতে কেতাবি বিচার স্তব্ধ প্রায়। থমকে যায় আদালতপাড়া। সন্তানের কান্নায় কাঁদলেন বাবা-মা। সে কান্নার রোল ছড়িয়ে গেলে আদালতের আনাচে-কানাচে। কাঁদলেন বিচারক, আইনজীবীরাও। সে কান্নায় সুর মিলালেন ডিভোর্স হয়ে যাওয়া বাবা-মা।

সোমবার দুপুরের ঘটনা। এভাবে চললো তিন ঘণ্টা। উচ্চ আদালতের ৯নং এজলাস কক্ষে এমনই এক হৃদয়গ্রাহী ঘটনাপ্রবাহ জাগ্রত করলো বিবেককে। যেন সিনেমাকেও হার মানালো।

প্রেম করে বিয়ে। সুখের সংসার। এরই মাঝে পারিবারিক কলহ। তারপর ১৩ বছরের সংসারে বেজে ওঠে বিচ্ছেদের সুর। স্বামী এবং স্ত্রী আলাদা হওয়ার পর থেকে সন্তানরা ছিল বাবার কাছেই। যদিও মায়ের কাছেও থাকার বিধান আছে সন্তানের। কিন্তু সে বিধান আমলে নেয়নি বাবা। এমনকি মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎও করতে দেয়া হয়নি সন্তানদের।

কিন্তু আদালতের দারস্থ হয়ে সন্তানের মাধ্যমে ডিভোর্স বাতিল করে এক হতে চান এই দম্পতি। বুকের নাড়ি ছেড়া ধন, নিজের ঔরসজাত দুই ছেলে সন্তানকে দেখতে এবং কাছে পেতে মরিয়া মায়ের জয় হলো আজ। দুই সন্তান মায়ের হাত ধরে হাসতে হাসতে মায়ের ঘরে ফিরে গেল।

আদালতে বিচারক ও আইনজীবীর সঙ্গে উপস্থিত বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনসহ সবাইকে আবেগাপ্লুত করে তুলেছিল দুই ছেলে। সবার চোখে ছিল ছলছল পানি। আদালতের ভেতরে সেইক্ষণের পরিবেশ ছিল ভারি হয়ে ওঠে। সন্তানরাও যে মা-বাবাকে এমন কড়া শাসন করতে পারে এই ঘটনা না দেখলে কারও বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়।

মা-বাবার সঙ্গে পরিবার নিয়ে প্রথমে ঢাকায় বসবাস করলেও ২০১৭ সালের মে’তে বিবাহবিচ্ছেদ (ডিভোর্স) হওয়ার পর বাবা দুই ছেলেকে মাগুরায় ফুফুর কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানে লেখাপড়া করানোর জন্য তাদের দুই ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করা হয়। এদিকে, বিচ্ছেদ হওয়ার পর মায়ের ঠিকানা হয় ঢাকার মোহাম্মদপুরে। অন্যদিকে, বাবার ব্যবসার দেখাশোনা করার সুবাদে বসবাস উত্তরায়।

হাইকোর্টের নির্দেশনাই আদালতে উপস্থিত হয়ে বাবা-মায়ের সংসার জোড়া লাগাতে ১২ বছরের শিশু ধ্রুব ও ৯ বছরের শিশু লুব্ধ অঝোরে কাঁদছে। তাদের কান্নায় সঙ্গী হন উপস্থিত সবাই। তাইতো তাদের কান্না দেখে এজলাস কক্ষে কাঁদলেন স্বয়ং বিচারপতি ও উপস্থিত শতাধিক আইনজীবী এবং সাংবাদিকরাও।

সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ দৃশ্যের অবতারণা হয়।

জানা গেছে, শিশু দু’টির মা কামরুন্নাহার মল্লিকা রাজশাহীর মেয়ে, বাবা মেহেদী হাসান মাগুরার ছেলে। মল্লিকা ঢাকায় গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে এবং মেহেদী ঢাকা কলেজে পড়েছেন। পড়ালেখা করা অবস্থায় দু’জনের পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম, অতঃপর দুই পরিবারের সম্মতিতে ২০০২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে।

ঘর আলোকিত করে আসে দু’টি ফুটফুটে সন্তান। মল্লিকা ও মেহেদী দম্পতি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। ভালোই চলছিল সংসার জীবন। একপর্যায়ে দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটে। পরিণতিতে ২০১৭ সালের ১২ মে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এরপর মাগুরাতে বড় হচ্ছিল শিশু দু’টি। এই এক বছর মা ও সন্তানের মধ্যে দেখা হয়নি।

মা কামরুন্নাহার মল্লিকার অভিযোগ, সব রকম চেষ্টা করেও শিশু দু’টির ফুফুর কারণে তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সন্তানদের নিজের হেফাজতে নেয়ার জন্য হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন তিনি।

কামরুন্নাহার মল্লিকা তার দুই সন্তানকে নিজ হেফাজতে নেয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করলে গত ২৯ মে আদালত শিশু দু’টিকে হাইকোর্টে হাজির করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও শিশু দু’টির বাবাকে নির্দেশ দেন। ২৫ জুন তাদের হাজির করতে বলা হয়।

একই সঙ্গে সন্তানকে কেন মায়ের হেফাজতে দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। সেই নির্দেশ মোতাবেক শিশু দু’টিকে আজ আদালতে হাজির করে পুলিশ। এছাড়া শিশু দু’টির বাবা-মা, মামা, নানি ও ফুফুসহ আত্মীয়-স্বজনরা আদালতে হাজির হন।

সকালে এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। শুনানির এক পর্যায়ে শিশু দুটির বক্তব্য শুনতে চান আদালত। দুই শিশুর মধ্যে বড়জন সালিম সাদমান ধ্রুব আদালতকে বলেন, আমরা আর কিছু চাই না, বাবা-মাকে একত্রে দেখতে চাই।

শিশু দু’টির বক্তব্য শুনে আদালত ফের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনেন। এ সময় মায়ের পক্ষের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতকে বলেন, একটা বছর ধরে মা তার সন্তানকে দেখতে পাচ্ছেন না। আজকে যখন কোর্টে হাজির করা হয়েছে তখনও শিশুর ফুফু মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বাধা দিয়েছে। এ সময় তিনি সন্তানদের সঙ্গে মায়ের কথা বলার সুযোগ চান।

পরে আদালতের অনুমতি পেয়ে ছেলেদের কাছে এগিয়ে যেতেই মা দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করেন। এ সময় ছেলেরাও দীর্ঘদিন পর মাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। বড় ছেলে তখন হাত বাড়িয়ে বাবাকেও ডাকতে থাকে।

ছেলে বলতে থাকে, বাবা, তুমি এসো। তুমি আমার কাছে এসো। আম্মুকে সরি বলো। এ সময় বাবাও এগিয়ে এলে আদালতের ভেতর এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। বাবা-মা এবং তাদের সন্তানদের একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য দেখে বিচারক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সবার চোখে পানি চলে আসে। দীর্ঘ এক বছর পর বাবা-মাকে একসঙ্গে পেয়ে ছেলেদের কান্না সবার বিবেককে নাড়া দেয়।

এ সময় আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক আবার ওই শিশুদের ডেকে নেন। সঙ্গে মাকেও কাছে ডাকেন। আদালত বলেন, এ দৃশ্য দেখেও কি আপনাদের মন গলে না? আপনারা কি সন্তানের জন্যও নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবেন না? সামনে তাকিয়ে দেখেন, আপনাদের এ দৃশ্য দেখে সবার চোখেই পানি চলে আসছে।

এ সময় আদালতে উভয়পক্ষের আইনজীবীসহ শতাধিক আইনজীবী দাঁড়িয়ে সমস্বরে সন্তানদের বিষয়টি চিন্তা করে বাবা-মাকে মেনে নেয়ার দাবি জানান। একই সঙ্গে সন্তানদের চাওয়া অনুযায়ী তাদের দাম্পত্য জীবন যাতে বজায় থাকে এ সেরকম একটি আদেশ দেয়ার দাবি জানান।

পরে আদালত দুই শিশু এবং তাদের বাবা-মা, নানি ও ফুফুকে আদালতের এজলাসের কাছে ডেকে নেন। একে একে প্রত্যেকের বক্তব্য শোনেন। পরে বিস্তারিত জানতে চেম্বারে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় বাবা ও মাকে।

আদালত আদেশে বলেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত শিশু দুটি মায়ের হেফাজতে থাকবে। তবে এই সময়ে পিতা শিশুদের দেখাশোনা করার সুযোগ পাবেন। আগামী ৪ জুলাই পরবর্তী দিন ঠিক করে শিশু দুটিকে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি মুলতবি করেন।

আদালতে শিশু দুটির বাবার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তাপস বল। মায়ের পক্ষে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। ও তার সঙ্গে ছিলেন এ কে এম রিয়াদ সলিমুল্লাহ।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)