ছেলেদের ১৮ বছর আগে টেস্ট খেলা আইরিশ মেয়েদের গল্প
অনলাইন ডেস্ক:
আয়ারল্যান্ড ক্রিকেটের জন্য আজ এক ঐতিহাসিক দিন। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবারের মত টেস্ট খেলতে নামবে আইরিশরা। কিন্তু জানেন কি? এটিই আয়ারল্যান্ড ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম টেস্ট নয়! ১৮ বছর আগেই তারা প্রথমবারের মত টেস্ট খেলে ফেলেছিল! এমনকি বাংলাদেশেরও টেস্ট যোগ্যতা অর্জনের আগেই! তাও আবার এই পাকিস্তানেরই বিপক্ষে!
সে সময় নারীদের ক্রিকেট আলাদাভাবে ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ক্রিকেট কাউন্সিল (IWCC) পরিচালনা করতো। পাকিস্তান ক্রিকেট দল টেস্ট ম্যাচ খেলার প্রস্তাব দিলে আইরিশরা রাজী হয়ে গেল। ব্যাপারটা তখন এতটাই সাধারণ ছিল। একটা বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেলেই মেয়েদের দল টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যেত। ২০০০ সালের মধ্যে আইরিশরা ছাড়াও এমনকি নেদারল্যান্ড এবং ডেনমার্কের মেয়েদের দলও টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে গেছিল।
তবে মেয়েদের ক্রিকেট কাউন্সিল একেবারেই অ্যামেচার এবং স্বেচ্ছাসেবী হওয়ায় তাদের অর্থনৈতিক সংকট ছিল প্রচুর পরিমাণে। সে বছরই আইরিশ নারী দলের নিউজিল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলতে যাবার কথা ছিল, সেখানে অনেক খরচার ব্যাপার ছিল বলে তারা পাকিস্তানের সাথে এই টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করবে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না।
এদিকে ১৯৯৭ সালে পাকিস্তানে নারী ক্রিকেট চালু করেছিল শাইজা এবং শারমীন খান নামে দুই বোন। তারা এমনকি নিজ দেশে অনুশীলনও করতে পারতো না, মৃত্যুর হুমকীর মধ্যে দিন কাটাতে হতো তাদের। পিসিবি নারীদের দলের অস্তিত্বই স্বীকার করতো না। এই দুই বোনকে নিজেদের টাকাতেই সমস্ত সফরের খরচ চালাতে হত। এমনকি পাকিস্তানে মেয়েদের ক্রিকেটের আসল অভিভাবক কারা, এ নিয়েও দুটি সংস্থার মধ্যে টানাহেঁচড়া ছিল। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান উইমেন্স ক্রিকেট কন্ট্রোল এসোসিয়েশনের অধীনেই এই সফরটি হয়েছিল।
এরপরেও টেস্টটা হলো কারণ দুই দেশের নারীদের দলই খুব কম ম্যাচ খেলার সুযোগ পেত। পুরুষদের ক্রিকেট বোর্ডকে নারীদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্যেও এই টেস্ট ম্যাচ খেলা জরুরী ছিল। এটা অনেকটা দেখিয়ে দেয়া যে, “দেখ, আমরাও টেস্ট খেলেছি।” আইরিশ লেগস্পিনার সিয়ারা মেটকালফ বলছিলেন যে তাদের একেকটা ম্যাচ খেলার মাঝে এত লম্বা বিরতি ছিল যে মনে হত তারা সারা বছর শুধু স্যান্ডউইচই খেয়ে যাচ্ছেন।
ম্যাচ শুরু হলো ২০০০ সালের ৩০ জুলাই, ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের মাঠে। খরচ কমাতে বেশিরভাগ আইরিশ প্লেয়ারদের নির্বাচন করা হয়েছিল মাঠের কাছাকাছি এলাকা থেকে। তারা প্রতিদিনের খেলা শেষে বাড়ি চলে যেতেন। স্থানীয় একটি রেস্তোরার ক্রিকেটপাগল মালিক পুরো ম্যাচে খেলোয়াড়দের বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আম্পায়াররা ঐ কলেজেই চাকরি করতেন। তাছাড়া চারদিন ধরে পিচের সুরক্ষা দেয়া দরকার ছিল বলেও নিরাপত্তার খাতিরে কলেজের মাঠটি বেছে নেয়া হয়েছিল।
আইরিশ প্লেয়ারদের তাদের যার যার কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে খেলতে আসতে হয়েছিল। একাধিক দিনের খেলা কীভাবে খেলবে সেটা নিয়ে তাদের ধারণাই ছিল না। পাকিস্তান দল তখন খুব একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিত না বলে তাদের সম্পর্কেও আইরিশদের তেমন ধারণা ছিল না।
পাকিস্তান টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং করে ৪৭ ওভার ৪ বলে মাত্র ৫৩ রানেই অল আউট হয়ে যায়। দুই অংকে যেতে পারে মাত্র ২ জন। বাকি ৯ ব্যাটারের মধ্যে ৪ জন আফ্রিদিকে ট্রিবিউট দিয়ে ০ রান করে, আর বাকি ৫ জনই করে ২ রান।
জবাবে আইরিশরা ৪৭ ওভার ব্যাট করে ৩ উইকেটে ১৯৩ রান করেই ডিক্লেয়ার দিয়ে দেয় কারণ তাদের মনে হচ্ছিল এই ম্যাচ বুঝি অনন্তকাল ধরে চলছে! দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তান ১ উইকেটে ৮ রান করতে প্রথম দিনের খেলা শেষ হয়। প্রথম দিনেই প্রায় ১০০ ওভারের কাছে খেলা হয়ে গেছিল এবং দুটো দলেরই প্রথম ইনিংস শেষ হয়ে গেছিল। অথচ আইরিশ প্লেয়ারদের কাছে একে প্রচন্ড বোরিং মনে হচ্ছিল।
দ্বিতীয় দিনে পাকিস্তানের ইনিংস প্রথম ইনিংসের তুলনায় একটু ভদ্রস্থ চেহারা নেয়। তবুও তারা ৫৪ ওভার ১ বলে ৮৬ রানেই অল আউট হয়ে যায়। এই ইনিংসেও চার জন ব্যাটার আফ্রিদিকে ট্রিবিউট দিয়ে ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। মজার ব্যাপার হলো, দ্বিতীয় ইনিংসে ২১ রানে ৬ উইকেট নেয়া ইসাবেল জয়েস প্রথম ইনিংসে একটি বলও করেননি! দেড় দিনেই শেষ হয়ে গেছিল টেস্ট ম্যাচ। আইরিশরা জিতেছিল ইনিংস ও ৫৪ রানে।
এর আগে ২ ম্যাচের একটি ওয়ানডে সিরিজ আয়োজন করা হয়েছিল যাতে আইরিশরা ২-০ তে জিতেছিল, কিন্তু ৪ দিনে হবার কথা কথা থাকলেও এই টেস্ট দেড় দিনেই শেষ হয়ে যাওয়ায় বাকি দিনগুলোর জন্য দুই দলের সম্মতিতে একই মাঠে দুটো ওয়ানডেরও আয়োজন করা হয়, যার প্রথমটিতে আইরিশরা পাকিস্তানকে ৭০ রানে অলআউট করে ১৩৮ রানের জয় পায়।
দ্বিতীয় ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে যায়। মোট ৫ ম্যাচের সিরিজে আয়ারল্যান্ড ৪-০ তে পাকিস্তানকে হোয়াইট ওয়াশ করে।
তবে এরপরে আইরিশ নারী দল আর একটাও টেস্ট খেলেনি। তাদের জন্য বিশ্বকাপে সুযোগ করে নেয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় তারা ৫০ ওভারের ওয়ানডেই বেশি করে খেলায় মনোযোগী হয়ে গেল। এই টেস্টের পরের বছরেই আইরিশ উইমেন্স ক্রিকেট ইউনিয়ন ক্রিকেট আয়ারল্যান্ডের সাথে মিশে গেল।
২০০৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ক্রিকেট কাউন্সিল বিলুপ্ত হয়ে আইসিসিই নারীদের ক্রিকেটের হর্তাকর্তা হয়ে গেল। এরপরে নারীদের টেস্ট ক্রিকেট ধীরে ধীরে এজেন্ডা থেকেই সরে চলে গেল, আর আইরিশ নারীদের খেলা ঐ একটা টেস্টই হয়ে গেল ইতিহাসের অংশ।
তথ্যসুত্র: ক্রিকেট মান্থলি, ইএসপিএনক্রিকইনফো