আধুনিকতার ছোঁয়ায় আশাশুনি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় মোরগ মুরগী

সচ্চিদানন্দদেসদয়,আশাশুনি:
আশাশুনির গ্রামে-গঞ্জে এখন আগের মত দেশীয় মোরগ-মুরগী চোখে পড়ে না। যৎ সামান্য গৃহস্থর বাড়িতে মোরগ-মুরগী পালিত হয়। তা অধিক মূল্যে বিক্রি হয়। বর্তমানে দেশীয় মোরগ-মুরগী অনেকটা বিলুপ্তির পথে।
আজ থেকে প্রায় ২০ বছর পূর্বে আশাশুনির প্রতিটি গ্রামে গৃহস্থর ঘরে ধানের গোলার নিচে আলাদা টংঘর নির্মাণ করে মোরগ-মুরগীর জন্য ঘর তৈরি করা হত। প্রত্যেকটি পরিবার অন্যান্য পশু পালনের পাশাপাশি দেশীয় মোরগ-মুরগী পালন করে গৃহবধূরা একটি বিশাল অংকের রোজগার করত। এখন সে দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আশাশুনির বিভিন্ন এলাকায় এখন মুরগীর ফার্ম গড়ে উঠায় মানুষ অনায়াসে পেয়ে যাচ্ছে মোরগ-মুরগী। এ বয়লার মুরগীগুলো অতিরিক্ত খাবার খেয়ে খুব তাড়াতাড়ি বড় হওয়ায় এ মুরগীর ফার্মের দিকে ঝুঁকেছে অনেক যুবক এবং অনেকেই সফলও হয়েছেন। বর্তমানে যদিও বয়লার ও ফার্মের মুরগীর ব্যবসা ততটা লাভজনক না হলেও তবুও এ পেশায় অনেকেই গা লাগিয়ে দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মোরগ-মুরগী পালন তথা উৎপাদন ব্যবসা।
আজ থেকে ২০ বছর আগেও আশাশুনির বিভিন্ন পাড়ায়-পল্লীতে ভোর বেলা মোরগের ডাক শোনা যেত। এ সকল মোরগ একটু বড় আকৃতির হত। সে মোরগের ডাকে অনেকের ঘুম ভাঙত।  বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে দেশীয় খাবার খেয়ে বড় হওয়া মোরগ-মুরগীগুলো আস্তে আস্তে বেড়ে উঠে এবং এগুলো খুবই সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং শরীরের জন্য উপযোগী। বয়লার তথা ফার্মের মুরগীগুলো রাসায়নিক জনিত খাবার খেয়ে খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠায় এগুলোর স্বাদ তেমন নেই বললেই চলে।
এক সময় কোন মেয়ের জামাই শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে আসলে কোন নামি-দামি মেহমান আসলে মোরগ-মুরগী জবাই করে তাদেরকে আপ্যায়ন করা হত। সে সময় গিয়ে অনুষ্ঠানেও বরযাত্রীদের জন্য আপ্যায়নের জন্য  মাংসের পাশাপাশি মুরগীর মাংস একটি মেন্যু হিসেবে বাধ্যতামূলক করা হত। বর্তমানে সে রেওয়াজ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন প্রতিটি বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠানে মুরগী দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু অনেকেই এ ধরনের বয়লার বা ফার্মের মুরগী না খাওয়ার কারণে টেবিলের মধ্যে মুরগীর মাংস থেকেই যায়। এখনো দেশীয় মুরগীর স্বাদ আলাদা হওয়ায় হোটেল-রেস্তোরাঁয় দুই ধরনের মোরগ-মুরগী রান্না করা হয়ে থাকে। সে সাথে দেশীয় মোরগ-মুরগীর মাংসের দামও বেশি নেয়া হয়। কিন্তু ফার্ম বা বয়লার মুরগী বাজারে ১শ ৩০ থেকে ১শ ৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করলেও, দেশীয় মুরগীর দাম ৩শ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। তাছাড়া দেশীয় মুরগীর চাহিদা বেশি থাকায় সে পরিমাণ মুরগী বাজারে না আসার কারণে দাম চড়ায় থাকে সব সময়।
স্থানীয় মুরুব্বীদের মতে দেশীয় মোরগ- মুরগীগুলো ২০ থেকে ৩০টি ডিম দেয়। এ ডিমগুলো সূর্য না দেখে,  বাড়ির এমন একটি জায়গায় জমায়েত করে রাখা হয়। পরবর্তীতে মুরগীর ডিম দেয়া শেষ হলে একটি খাঁচায় করে বাচ্চা ফুটানোর জন্য স্থান করে দেয়া হয়। সেখানে মুরগীটি তা দিয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন পর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে তাদের বংশ বিস্তার করে। এমনকি এ সকল মুরগী দিয়ে হাঁসের বাচ্চাও ফুটানো হত বলে তারা জানান। ফলে এ বাচ্চাগুলো গৃহস্থের লালন-পালনের মধ্য দিয়ে আসতে আসতে বড় হতে থাকে। সময় লাগে অনেক। ফলে এ কষ্ট বর্তমান সমাজের লোকজন করতে চায় না। তাই তারা ফার্মের তথা বয়লার মুরগী ক্রয়ের জন্য তাদের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় মোরগ-মুরগী। এক সময় হয়তো দেশীয় মোরগ-মুরগী আষাঢ়ের গল্পের মত শুনবে আগামী প্রজন্ম। তাই এ দেশীয় মোরগ-মুরগীর স্বাদ পেতে এবং ধরে রাখতে সরকারিভাবে দেশীয় মোরগ-মুরগী লালন-পালনের উপর পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবী জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল। অন্যথায় এ সুস্বাদু দেশীয় মোরগ-মুরগী আমাদের দেশ ও সমাজ থেকে এক সময় হারিয়ে যাবে।
দেশীয় প্রজাতির মোরগ-মুরগীর ব্যাপারে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা  বলেছেন, বর্তমান বাজারে এটার চাহিদা থাকার কারণে মানুষ আবার নতুন করে মোরগ-মুরগী লালন-পালনে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। দেশীয় তুষ পদ্ধতিতে ডিম ফুটানো এবং মুরগী ছাড়া বাচ্চা পালনের ব্যবস্থা করা, মুরগী অধিক ডিম দেয়ার ব্যাপারে গৃহস্থদের বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এতে এর ফলপ্রসু অগ্রগামী হবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি আরও বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমানুপাতে চাহিদা মোতাবেক দেশীয় মোরগ-মুরগী উৎপাদন পর্যাপ্ত না হওয়ায় অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে দেশীয় মুরগীর গ্রোদ কম। কিন্তু ফার্ম মুরগীর গ্রোদ বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে সেদিকে ঝুঁকে পড়েছে। এখনো পর্যন্ত দেশীয় মুরগীর যে চাহিদা রয়েছে এটাকে আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে কাজ করি বা ফার্মিং করি সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ ব্যাপারে এগিয়ে আসলে এক্ষেত্রে অর্থনীতিক সমৃদ্ধিসহ দারিদ্র ও বেকারত্ব নিরসনে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)