বাংলাদেশের এই গ্রামে যেখানেই দেয়াল, সেখানেই রঙের ছোঁয়া

রংবেরঙের আঁকিবুকি প্রতিটি বাড়ির দেয়ালজুড়ে। যেন এক রঙের খেলা। প্রত্যেকের ঘরে ঘরে ক্যানভাস। এমনই দৃশ্য দেখতে পাবেন আলপনা গ্রামে। ভাবছেন হয়ত, এই নামেও কোনো গ্রাম আছে বলে জানি না তো? আসলে গ্রামটির নাম টিকইল। এর অবস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নে। এই অজপাড়াগাঁয়েরই গৌরব হলো আলপনা।

স্কুল পড়ুয়া রীমা বর্মন। বয়স তার দশ বছর। মা এবং দাদির আঁকা দেখে দেখে আলপনা আঁকতে শিখেছে সে। তাই কোনো উৎসব এলেই তার ব্যস্ততা বেড়ে যায় রং-তুলি নিয়ে। তার বয়সি গ্রামের অনেক মেয়েকে আলপনা আঁকার তালিমও দেয় সে। শুধু রীমা নয় তিতলি, নয়নার মত অনেক শিশুরাও এই আলপনা আঁকায় হাত পাকাচ্ছে এখন থেকেই। মনের মাধুরী মিশিয়ে তারা আলপনা আঁকায় মনোযোগ দেয়। মা-বাবারও নেই নিষেধ। বরং এই বিষয়ে তাদের আগ্রহের সীমা নেই।

আলপনা আঁকায় ব্যস্ত এক কিশোরী

আলপনা আঁকায় ব্যস্ত এক কিশোরী

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম টিকইল। এ গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে রংবেরঙের বাড়ি-ঘর। প্রায় অর্ধশতাধিক বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে আলপনার শোভা। বাইরের দেয়াল থেকে শুরু করে ভেতরের দেয়াল, বৈঠকখানা, বারান্দা, এমনকি রান্নাঘর- যেখানেই দেয়াল, সেখানেই রঙের ছোঁয়া। বিভিন্ন উৎসবকে ঘিরে আঁকা হয় এসব আলপনা, যা দেয়ালে থেকে যায় সারা বছর। রং নষ্ট হলে আবার দেয়া হয় তুলির আঁচড়। আর এসব আলপনা দেখতে অনেকে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন।

আলপনার কারিগর কারা?
তবে এসব আলপনা কিন্তু কোনো শিল্পীর আঁকা নয়। প্রত্যেক বাড়ির নারীর হাতের ছোঁয়ার রঙিন এই গ্রামটি। বংশ পরম্পরায় সৌন্দর্য বর্ধন ও দেবতার সুদৃষ্টি ও আশীর্বাদ কামনায় এ ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন টিকইল গ্রামের নারীরা। নির্জন এই গ্রামটির প্রত্যেকটি মাটির বাড়ির দেয়ালজুড়ে রয়েছে অব্যক্ত অনেক গল্প। এসব গল্পের রং লাল, নীল, হলুদ কিংবা সবুজ।

নববধূর হাতের আলপনায় রঙিন হচ্ছে বাড়ির উঠান

নববধূর হাতের আলপনায় রঙিন হচ্ছে বাড়ির উঠান

আবার অনেকের দেয়ালের গল্প শুধু লাল আর সাদা। প্রত্যেকের সৃষ্টির এক ভিন্নরূপই হলো এই গ্রামটি। কারো আলপনার সঙ্গে মিল নেই অন্য কারোর। এই রঙের খেলা বিভিন্ন সময়ের গল্প বলে। কখনো তাদের ধর্মীয় উৎসবের কথা আবার দুঃখের স্মৃতি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে মাটির বুকে সেঁটে থাকা এসব গল্পের পরিচয় এই গ্রামের সহজ-সরল মানুষের শৈল্পিক মন।

প্রায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হিন্দু বাড়িগুলোতে এই সংস্কৃতি চলে আসছে। বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে আলপনা এই গ্রামে নতুন কিছু নয়। তাই আলপনায় স্থান পায় ধর্মীয় নানা চিহ্ন, কথামালা। একসময় বিভিন্ন তিথি-উৎসবে মাটির দেয়ালের পাশ দিয়ে তিনটি ফোঁটা দিয়ে নিচের দিকে সাদা রঙের আলপনা টেনে দেয়া হতো। এখন আর তিন ফোঁটার টান নয়, আঁকা হচ্ছে ফুল, পাখি, আকাশ, নদীসহ বাংলার চিরায়ত ছবি।

রং তৈরির উপকরণ

রং তৈরির উপকরণ

আলপনায় হাত পাকা এক নারী দেখন বালা বলেন, প্রত্যেক কাজের পিছনেই ধৈর্য্য ধারণ করতে হয়। ভালো লাগার জায়গা থেকে আলপনা আঁকা। এতে বাড়িঘর দেখতে ভালো লাগে। মানুষও ভালো বলে। প্রতিবছর আমি নকশা পরিবর্তন করি। যখন যেটা ভালো লাগে সেটাই আঁকি। প্রথমদিকে আলপনা আঁকার উপাদান প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতাম। এখন বাজার থেকে কিছু রং, খড়িমাটি, চুন কিনে কাজ করি।’

আলপনা আঁকতে যা ব্যবহার করা হয়
তারা নিজেদের তৈরি করা রং ব্যবহার করেন আলপনা আঁকতে। এখানকার মাটির ঘরে আলপনা করার রঙের উৎসও মাটি। গ্রামবাসীর ভাষ্যমতে, আগে নারীরা আলপনা আঁকতে গিরিমাটি, চক (খড়িমাটি), রং, তারপিন তেল ব্যবহার করতো। তবে ওইসব উপকরণে আঁকা আলপনা বেশিদিন স্থায়ী হতো না। তাই বর্তমানে শুকনা বরই চুর্ণ আঠা, গিরিমাটি, আমের পুরাতন আঁটির শাঁস চুর্ণ, চকগুঁড়া, বিভিন্ন রং, মানকচু ও কলাগাছের কষ দিয়ে তৈরি রংয়ের মিশ্রণ অন্তত ৪ থেকে ৫ দিন ভিজিয়ে রেখে আলপনা আঁকা হয়। এ কারণে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় স্থায়ী হয় এসব আলপনা।

দেয়াল ও দর্জা ভর্তি আলপনা

দেয়াল ও দর্জা ভর্তি আলপনা

আলপনা গ্রামটিকে করেছে ভিন্ন
নেজামপুর ইউনিয়নের হাটবাকইল বাজার থেকে উত্তর দিকের সড়ক ধরে এগোতেই চোখে পড়বে আলপনার গ্রামের রঙের বাহার। মাটির রংবেরঙের সারি সারি বাড়ি। প্রতিটি বাড়ি অন্যটির চেয়ে আলাদা। যতই গ্রমের মধ্যে ঢুকবেন সোদা মাটি আর রঙের গন্ধ আপনাকে উদাসীন করে তুলবে। সঙ্গে বাহারি রঙের খেলা দেখে হারিয়ে যাবেন অন্য জগতে। আর তাইতো বিদেশ থেকেও পর্যটকরা এই গ্রামে ঘুরতে আসেন।

নারীরাই আলপনা গ্রামের প্রাণ সঞ্চার করেছেন। এরা সবাই কিন্তু নিজ গুণে অনন্য। কেউ শিখেছেন দাদির কাছে কেউবা মা, খালার কাছ থেকে। তেমনই এক নারী শিল্পী বর্মন। তার দুটো হাতের চামড়া কুচকে গেছে এই আলপনা আঁকতে আঁকতে। তিনি জানান, তার হাত ধরে টিকইল গ্রামের অনেক মেয়ে ও বধূ আজ আলপনা আঁকায় হাত পাকিয়েছেন।

হাস্যোজ্জ্বল নারী

হাস্যোজ্জ্বল নারী

আলপনার রঙিন উপস্থাপনায় পৌষ-পার্বণে বাড়ির দেয়ালগুলো হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় ও সুন্দর। তারই কন্যা রেখা বর্মন জানান, বিভিন্ন পূজা-পার্বণে, বিশেষ করে নবান্নে আলপনা এঁকে থাকি। আর এই আলপনা আমরা বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধন ও দেবতাকে খুশি করতেও এঁকে থাকি। আবহমানকাল ধরেই বাঙালির বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা রঙের ছড়াছড়ি।

কারুকার্যময় আলপনা সেই স্মরণাতীতকাল থেকেই বাংলায় প্রচলিত। নারীরা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আলপনার এ অনুশীলন করে আসছেন। নানা গবেষক ও পূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আলপনাকে প্রাক-আর্য সময়ের নিদর্শন বলে চিহ্নিত করেছেন। তবে বর্তমানে থার্টি ফার্ষ্ট নাইট, একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপনেও আলপনা আঁকা হচ্ছে। লোকশিল্প গবেষকদের মতে, ‘আলপনা’র অতীতেও যেমন আবেদন ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও তা অটুট থাকবে।

দেয়ালের আলপনায় শোভা পেয়েছে ধর্মীয় শ্লোক

দেয়ালের আলপনায় শোভা পেয়েছে ধর্মীয় শ্লোক

আলপনার ইতিহাস
লোকশিল্প গবেষকদের ধারণায় প্রাগৈতিহাসিক কালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে অস্ট্রিক সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল, আলপনা তারই ফল। এই ধারা সুদূর মেক্সিকো পর্যন্ত প্রসার লাভ করেছিল। তাই বলা যায়, প্রাগৈতিহাসিক ও আধুনিক মানুষের লৌকিক শিল্প অভিব্যক্তির মধ্যে আলপনা এক অভিনব মিলনসেতু! আলপনার রং হিসেবে একেক জায়গায় একেক রকমের রং তৈরি ও ব্যবহার হয়।

আতপ চালের গুঁড়া, সিঁদুর, হলুদের গুঁড়া, ইটের গুঁড়া, পাতিলের কালি, কাঁচা গোবর গোলা পানি, মেহেদী বাটা রং ইত্যাদি দিয়ে সনাতন আলপনা তৈরি করা হতো এবং এখনো হয়। বর্তমানে আলপনা করার জন্য নানা ধরণের কৃত্রিম রং কিনতে পাওয়া যায়। ঝামেলাহীন বলে এসব রঙেই আলপনা আঁকা হয় বেশি। বিভিন্ন ব্রত ও লোকাচারের সঙ্গে আলপনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

সুদূর অতীত থেকে ব্রতানুষ্ঠানে অংকিত হয়েই আলপনার বিকাশ ঘটেছে। প্রাচীনকালের অপরিণত সমাজের লোকরা যেসব কামনা-বাসনা পূরণের জন্য দেবতাদের দ্বারস্থ হতেন, সেসবের প্রতিচ্ছবি অংকিত হয়েছে আলপনায়। প্রার্থিত বিষয়ের মনগড়া প্রতীক চিহ্নগুলো মনোজ্ঞ রূপায়নই হলো আলপনা।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)