এই রুবেল সেই রুবেল

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকাই সিনেমায় আবির্ভূত হয় একজন অ্যাকশন হিরোর। রাজ্জাক, ইলিয়াস কাঞ্চন, সোহেল রানাদের তখন দাপুটে সময়। এদের ভেতরেই জায়গা করে নেন রুবেল।

পুরোনাম মাসুম পারভেজ রুবেল। ঢাকাই ছবিতে তিনি মার্শাল আর্ট কিংবদন্তি ও অ্যাকশন কিং হিরো হিসেবে সুপরিচিত। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২৩০টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন।

অভিনয়ের মধ্যেই নিজের প্রতিভা আটকে রাখেননি। ছবিতে গানও গেয়েছেন। মূলত ১৯৮১ সালে গান দিয়েই যাত্রা শুরু তার। এরপর বড় ভাই সোহেল রানার হাত ধরেই চিত্রপাড়ায় প্রবেশ তার। ২২ বছর বয়সে ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে পরপর দু’বার জাতীয় কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদকও ছিল তার দখলে।

১৯৮৬ সালে শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘লড়াকু’ ছবিতে অভিনয় করার মধ্য দিয়ে ঢাকাই সিনে ইন্ডাস্ট্রিতে নায়ক হিসেবে পথচলা শুরু করেন রুবেল। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। এরপর একই পরিচালকের সঙ্গে জুটি বেঁধে ২৭টি ছবিতে অভিনয় করেন এ নায়ক। ব্যতিক্রমী ভাবনার সব ছবি উপহার দিয়েছেন তারা দু’জন।

তার মধ্যে রয়েছে সামাজিক, রোমান্টিক কিংবা কমেডি ঘরানার ছবি। এ নায়ক-পরিচালক জুটির সব ছবিই পেয়েছে ব্যবসায়িক সাফল্য।

২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘চাই ক্ষমতা’ রুবেল আর খোকন জুটির শেষ ছবি। নায়ক রুবেল অভিনীত তেমন কোনো ছবিই ফ্লপ বা ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়নি। এমনকি তার অভিনীত প্রথম টানা ১০টি মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিই ছিল সুপারহিট ও বাম্পারহিট।

অভিনেতার পাশাপাশি প্রযোজক, পরিচালক, ফাইট ডিরেক্টরও রুবেল। তার অভিনীত বেশিরভাগ ছবির ফাইট ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। ‘দ্যা একশন ওয়ারিয়রস’ নামে একটি ফাইটিং গ্রুপ রয়েছে তার। ৯০ দশকের একেবারে শেষের দিকে প্রযোজনা ও পরিচালনায় নাম লেখান এ অভিনেতা।

১৯৯৯ সালে তার প্রযোজনায় প্রথম ছবি ‘বাঘের থাবা’ মুক্তি পায়। ছবিটি ব্যবসা সফলও হয়। তার প্রযোজনায় পরের ছবি ‘মায়ের জন্য যুদ্ধ’ নিজেই পরিচালনা করেন রুবেল। এটি ২০০১ সালে মুক্তি পায়।

তার প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবি ‘বিচ্ছু বাহিনী’, একটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় ২০০১ সালে এবং বছরের সেরা ছবি হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের প্রায় নতুন পুরনো সব নায়ক, নায়িকা ও ভিলেনের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন এই আনপ্যারালাল হিরো।

এক সময়ের ব্যস্ত এ নায়ককে এখন আর তেমন একটা পর্দায় দেখা যায় না। কারণটা তিনি এভাবেই বললেন- ‘বিনোদনের বড় খোরাক হচ্ছে ফিল্ম। সেই ফিল্মের আগের সোনালি দিন এখন আর নেই বললেই চলে। আগে দর্শক হলে টইটম্বুর ছিল, এখন সেদিন আর নেই।

আমি শ্রদ্ধার সঙ্গেই বলছি, আগে নির্মাতারা গল্প নিয়ে ভাবতেন, পড়তেন। এখনকার অনেক নির্মাতা এটা করেন না। আমার মনে হয় এই বোঝাপড়াটা না হওয়ার জন্য ফিল্মটা একটু কাত হয়ে গেছে। তবে আমার বিশ্বাস ফিল্মের সুদিন ফিরবে।’

এখনও শারীরিকভাবে ফিট থাকা সত্ত্বেও অভিনয়ে দেখা না যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন- ফিল্ম খুব বেশি একটা না করার প্রধান কারণ হচ্ছে, আমি যে গল্পের চরিত্রগুলো পছন্দ করি বা মনের মতো চরিত্র সবসময় পাই না।

দু-একটা যা করি সেটা ভালোলাগা থেকে। আমরা যে সময় ফিল্ম করেছি তখন গল্পই ছিল প্রধান। আর এখন অনেকেই নায়ক-নায়িকাই বেশি প্রাধান্য দেন। এক কথায় বলতে গেলে আমি আমার ভালোলাগার কারণে সব কিছু করি।

সেই রুবেল ও এই রুবেলের কী পরিবর্তন হয়েছে, এমন প্রশ্নে এ অভিনেতা বলেন- এখন ডিজিটাল যুগ। সিনেমার অনেক দিকই পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের সময় অনেক বেশি কষ্ট করেই সিনেমা নির্মাণ করতে হতো। আর এখন তো ডিজিটাল পদ্ধতি এসে আমূল পরিবর্তন হয়েছে।

আগে ফাইটের দৃশ্যগুলো রিস্ক নিয়ে মাঝে মাঝে দিতে হতো। এখনকার সময়ে সেটি আধুনিক হয়েছে। সিনেমায় বিশেষ করে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কাজগুলো একটু উচ্চস্তরে নিয়ে গিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বলতে গেলে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। তবে ব্যক্তি রুবেলের কোনো পরিবর্তন নেই। আমি আগে যেমনটা ছিলাম, এখনও সেই আমিই আছি।

ইন্ডাস্ট্রিতে ছবিও আগের মতো হচ্ছে না। মানসম্মত তো বটেই, সংখ্যাগত দিক থেকেও যথেষ্ট কমে গেছে ছবি নির্মাণ। যে কয়টি হচ্ছে তার বেশিরভাগই মানহীন। পাশাপাশি সিনেমা হলের সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে কমছে।

এ প্রসঙ্গে রুবেল বলেন- ‘আমাদের সময়ে তখন বছরে অনেক ছবি মুক্তি পেত। প্রতিদিনই এফডিসিজুড়ে সিনেমার শুটিং হতো। মনে আছে পরিচালকরা ফ্লোর এবং এডিটিং রুম ফাঁকা পেতেন না। আর এখন এফডিসি বেশিরভাগ সময়ে ফাঁকা থাকে। শুটিং থাকলেও দেখা যায় কোনো বিজ্ঞাপনের নতুবা নাটকের। মূলকথা হচ্ছে, সিনেমার মানুষ আর নেই। বলতে গেলে সিনেমার আসল মানুষই নেই। আসল সিনেমা মেকার কয়জন আছে? আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে বলছি, টিভি মিডিয়ার অনেক মানুষই এখন সিনেমা নির্মাণ করছেন।

তবে তার কতগুলো সিনেমার মতো হচ্ছে এটিই আসল কথা। পর্দায় যদি সিনেমার মতো না লাগে এবং যা ঘরে বসে বা কম্পিউটারে বসে দেখা যাবে বিনা পয়সায়, তাহলে দর্শক কেন হলে যাবে দেখতে এসব জগাখিচুড়ি? নাটক বানিয়ে সিনেমা বলে চালিয়ে দিলে কি আর দর্শক পাওয়া যাবে? দুই একটি সিনেমা ছাড়া ভালো কোনো সিনেমা হচ্ছে না, তা সবাই জানেন এবং দেখছেন। এতে করে সিনেমা হল তো কমবেই।’

অভিনয়ে নিয়মিত না থাকলেও সম্প্রতি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সহসভাপতি হয়েছেন এ অভিনেতা। সংগঠনটি নিয়ে আগামীর পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

রুবেল বলেন- ‘অধিকার আদায়ের জন্য শিল্পীদের একটি ঘর এবং একটি আসনের দরকার হয়। আমি নির্বাচন করার আগে বলেছি যে, সিনেমার উন্নয়ন ও শিল্পীদের জন্য কাজ করে যাব এবং আমি সেটিই করব। দরকার যেখানে হবে সেখানে ছোটা। বর্তমানে সিনেমা হলের সমস্যা নিয়ে আমরা অবগত। দরকার হলে এটি নিয়ে সবাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে হলেও যাব। এখন অপেক্ষার পালা, দেখি কী হয়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)