রোবটরা কি আসলেই মানব সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হতে পারে?

ব্রিটেনের সবচেয়ে প্রভাবশালী কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের মতে, `কিলার রোবট` বা খুনি রোবটরা এখনো পর্যন্ত হলিউড ফ্যান্টাসি ফিল্মের অংশ মাত্র। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ের অধ্যাপক স্যার নাইজেল শ্যাডবোল্ট মনে করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমতা মানব সভ্যতার জন্য অভিভূত সুবিধা বয়ে আনবে, ক্যান্সার নির্ণয় এবং এর চিকিৎসায় বিপ্লব আনবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের ধারণার রূপান্তর ঘটাবে। শুধুমাত্র টারমিনেটর সিনেমার মত যদি এসব সংবেদনশীল মেশিনগুলো হঠাত দুর্বৃত্তে পরিণত হয় তবেই কেবল শুধু গোলমাল হওয়া সম্ভব।

“রোবটরা হঠাত স্বেচ্ছায় আমাদের খুন করা শুরু করবে এবং রোবট বিপ্লবের সূচনা ঘটাবে এমন কোন সম্ভাবনা নেই। এরকম তখনই হবে, যদি মানুষরা বোকার মতো তাদের এরকম কোন ইন্সট্রাকশন দেয় অথবা এমন কোন সফটওয়্যার তাদের মাঝে ইন্সটল করে দেয়া হয়; যেটা মানুষের অনুমতি ছাড়াই কনট্রোলের বাইরে গিয়ে মানুষকে খুন করতে সক্ষম। ” বলেন অধ্যাপক শ্যাডবোল্ট।

গেল সোমবার লন্ডনে হয়ে যাওয়া কগএক্স সম্মেলনে এক সাক্ষাতকারে শ্যাডবোল্ট এসব কথা বলেন। সম্মেলনটিতে প্রযুক্তি দুনিয়ার বেশ কয়েকটি নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান কৃত্রিম বুদ্ধিমতার সর্বাধুনিক সংযোজন এবং তাদের পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছিলো।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদয় মানব সভ্যতার অস্ত ডেকে আনবে , এমন ধারণা উড়িয়ে দিয়ে জার্মান কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং মেশিন লার্নিং এর অগ্রদূত ইউরগেন শিডহাবার বলেন, “বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিগুলো দেখছি এসব আইডিয়া আপনাদের মাথায় দিতে খুব শক্তি রাখে! যাই হোক, এসব সিনেমার প্লটগুলি আসলেই অর্থহীন। “

সুইজারল্যান্ডের লুজানে `নাইসেন্স` নামে শিডহাবারের নিজের একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি রয়েছে। তিনি সিনেমার এসব ব্যাপারকে প্রবল ব্যবসায়িক চাপ হিসেবেই দেখেন, যেখানে কোম্পানিগুলো মূলত মানুষের সুবিধার জন্যই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করছে।

তিনি বলেন, ” আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে ৯৫ শতাংশ গবেষণাই হয়ে থাকে মানব কল্যানের স্বার্থে। মানুষের আয়ু বৃদ্ধি, মানুষের জীবনকে আরো সবাস্থ্যসম্পন্ন আর সুখী করে তোলাই এসবের লক্ষ্য। সিনেমাওয়ালারা আপনাকে সেটাই দেখাবে যেটা আপনার জন্য মুখরোচক। “

যদিও বেশ আগে, এলন মাস্ক; যিনি টেসলা ইনকরপোরেটের সিইও এবং গুগলের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রোগ্রাম `ডিপমাইন্ড` এর একজন প্রধান বিনিয়োগকারী, বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মেশিন মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে বলে সতর্ক করেছিলেন। এই ধরণের স্বয়ংক্রিয় মেশিনগুলো বহু মানুষকে চাকরীচ্যুত করে সম্পদের বৈষম্য সৃষ্টি করবে এরকম চিন্তাও রয়েছে অনেক বিশ্লেষকদের মাথায়।

যাই হোক, মেশিন লার্নিং এর মতো উদীয়মান প্রযুক্তিসমূহ , যেসব কম্পিউটার প্রোগ্রাম বিপুল সংখ্যক ডাটাসেট ও প্যাটার্ন ব্যবহার করে শিক্ষা নেয়; তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে অধ্যাপক শ্যাডবোল্ট এর কণ্ঠে আশার বাণীই শোনা গেলো। ” আমি সত্যিই মনে করিনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মেশিনগুলো অতটা ব্যাপকভাবে মানুষের কাজের পরিধিকে ধ্বংস করছে। বরং এতে করে মানুষ একঘেয়ে কাজগুলো বাদ দিয়ে সৃজনশীল কাজগুলোতে আরও বেশি মনোনিবেশ করতে পারবে, তাদের সৃষ্টিশীল কাজগুলো আরো বেশি করে উৎসারিত হবে। ভ্রমণ বাণিজ্য, সমাজ কল্যাণ, এমনকি টেলিভিশন রিয়েলিটি শোগুলোর প্রসারও বাড়তে পারে। মানুষের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বাড়ানোই তো এই ডিজিটাল পৃথিবীর এক নম্বর চ্যালেঞ্জ। “

একই রকম ভাবে প্রফেসর শ্যাডবোল্ট মানুষের সাথে রোবটের আবেগিক বন্ধনকেও ইতিবাচকভাবেই দেখেন। “আমরা রোবটের মধ্যে অনেক মানবিক গুণাবলি দিয়ে দেবো, তাদের সাথে আবেগিক যোগাযোগ স্থাপন করতেও সক্ষম হব, কিন্তু সেজন্য রোবটদের আত্ম-সচেতন করে তোলার কোন প্রয়োজন দেখছি না। আপনি আপনার বাসার একুরিয়ামের গোল্ডফিশটার সাথেও আবেগিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন, যেমনটা আমার শৈশবে আমার টেডি বিয়ারটির সাথে আমি করতাম। “

যদিও তিনি স্বীকার করে নেন , আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জগতে নতুন সংযোজন; যেখানে রোবটরা ছবি বা ভিডিওর ব্যাখ্যা করাই শুধু নয়, নিজের বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নতুন ছবি বা ভিডিও তৈরিও করতে পারে, সেটি মানুষের মনে কিছু অস্বস্তিকর শঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে। “ভাবুন তো , একজন বিষাদগ্রস্ত বিধবা নারী চাইতেই পারেন তার প্রিয় স্বামীর কণ্ঠস্বরের কিছু একটা তার সাথে সর্বদা কথা বলুক! মৃতকোন প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর বা অবয়ব এভাবে ধরে রাখা সম্ভব হবে এই দিন কিন্তু বেশি দূরে নয়! আর এমনটাই ঘটতে যাচ্ছে, নিশ্চিত থাকুন।”

শ্যাডবোল্ট মনে করেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নৈতিকতা, তাদের কর্ম পরিধি, কিভাবে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, কিভাবে মানুষের পারসোনাল ডাটা ও মেডিকেল রেকর্ডসের মতো বিষয়গুলো এই প্রযুক্তি উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে- এসব বিষয়ে স্বচ্ছতা আনার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের এসব শঙ্কা এবং আলাপ আলোচনার সত্য্যিই বেশ প্রয়োজনীয়তা ছিল।

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোবটদের শিক্ষিত করার জন্য প্রয়োজনীয় এলগরিদম বানানোর ক্ষেত্রে মেডিকেল রেকর্ডসগুলো ব্যবহারের জন্য কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসসমূহের সাথে একটি সমন্বয় সাধন করেছে।

শিডহাবার বলেন, `সুপার হিউম্যান আর্টিফিশিয়াল ডক্টর` তৈরির জন্য মেডিকেল ডাটা গুলো সহজ প্রাপ্য করার সুবিধা অনেক। হাতে নাতেই তার ফলাফল মিলছে। সরকারী হেলথ সার্ভিস গুলো থেকে সহজেই রোগীদের ডাটা সংগ্রহ করা যায় বিধায় তিনি তাদের সতর্ক করে দেন, কারণ এর মাধ্যমে অনেক AI কোম্পানি কোন ফি ছাড়াই ডাটা গুলো পেয়ে যাচ্ছে। তিনি এ ব্যাপারে তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “তারা ভাবতেও পারছে না তাদের এ ডাটা গুলো কত মূল্যবান AI কোম্পানি গুলোর কাছে। আমি যদি ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের দায়িত্বে থাকতাম তবে অবশ্যই রোগীদের এসব তথ্য যাতে তার সঠিক মূল্য পায় সে জন্য একটি মার্কেট গড়ে তোলার চিন্তা করতাম।”

এখন পর্যন্ত তাই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইন্ডাস্ট্রি মানুষের কল্যাণের ব্যাপারটি মাথায় রেখেই কাজ করছে বলা যায়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)