জহির রায়হানের হারিয়ে যাওয়ার ৪৭ বছর
বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, জহির রায়হানও হারিয়ে গেল। না, কিংবদন্তী এই চলচ্চিত্রকার ও ঔপন্যাসিক পথ ভুল করে কিংবা মানসিক সমস্যায় ভুগে হারিয়ে যাননি, বরং তাঁকে চিরতরে সরিয়ে ফেলেছিল স্বাধীনতা বিরোধী শত্রুরা। এর একটাই কারণ; স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে শুরু করেন জহির রায়হান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন হবার পর ১৭ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখেন জহির রায়হান। এরপর তাঁর আরেক ভাই লেখক ও বুদ্ধিজীবী শহিদুল্লাহ কায়সারের খোঁজে ঢাকার মিরপুরে যান। সেই যে গেলেন, আর ফিরে আসলেন না। জহির রায়হানকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। প্রমাণ পাওয়া গেছে, ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং গুলি করে মেরে ফেলে।
জহির রায়হানের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ফেনী জেলায়। তিনি ছিলেন সাহিত্যের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৫০ সালের দিকে তিনি বেশ কিছু খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনে কাজ করতে শুরু করেন। এর পাশপাশি তিনি গল্প, উপন্যাস লেখা চালিয়ে যান। ১৯৫৫ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৭ সালে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। উর্দু ছবি ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র, যেখানে তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এরপর ‘যে নদী মরুপথে’, ‘নবারুন’, ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতেও সহকারী পরিচালক ছিলেন তিনি। মূল পরিচালক হিসেবে তাঁর নির্মিত প্রথম ছবি ‘কখনও আসেনি’ মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে। এরপর একে একে নির্মাণ করেন ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’ ও ‘জীবন থেকে নেয়া’-এর মতো বেশ কয়কটি ছবি। ১৯৭১ সালে নির্মাণ করেন তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘বার্থ অব এ নেশন’, ‘চিলড্রেন অব বাংলাদেশ’ ও ‘সারেন্ডার’। এছাড়া ‘সংগম’ ও ‘বাহানা’ নামে দুটি উর্দু ছবিও নির্মাণ করেন তিনি।
জহির রায়হানের লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হাজার বছর ধরে’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘বরফ গলা নদী’, ‘আর কতদিন’, ‘কয়েকটি মৃত্যু’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘তৃষ্ণা’ ও ‘আরেক ফাল্গুন’। এছাড়া তাঁর হাতে লেখা হয়েছে ২০টিরও বেশি গল্প।
কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশ বিদেশের বহু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন জহির রায়হান। এরমধ্যে রয়েছে মরণোত্তর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদকসহ বহু সম্মাননা। স্বাধীনতার সময় তিনি হারিয়ে গেছেন ঠিকই, কিন্তু মিশে আছেন বইয়ের মলাটে, ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ও চলচ্চিত্রের সাদাকালো ফ্রেমে।