যেভাবে হারাচ্ছে দর্শক ধরে রাখা সিনেমাগুলো
একটা সময় ছিল দর্শক সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করত টিভি দেখার। ওই সময় পুরো সপ্তাহজুড়ে একটি সিনেমায় প্রচারিত হত। শুক্রবার আসলে টিভিতে কখনো দেখা যেত নায়ক রাজ রাজ্জাককে (তার সিনেমা) আবার কখনো ফারুককে (তার সিনেমা) আবার কখনো অনেক কালজয়ী তারকাদের। তবে এখন সে সব দর্শক হারিয়ে গেছে। যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সিনেমা দেখার অপেক্ষা করত। এখন সিনেমা দেখার জন্য কেউ আর অপেক্ষা করে না।
তাছাড়া এখন তেমন কোন অভিজ্ঞ (সিনেমার) তারকাদেরও দেখা যায় না। সময়ের ব্যবধানে সিনেমার সব দর্শক হারিয়ে গেছে। এদিকে, হারিয়ে গেছে সে সব সিনেমাও, যা দেখে ছুটে আসত দর্শক। যার জন্য অপেক্ষা করত পুরো সপ্তাহ। এই সব সিনেমা হারিয়ে যাওয়ার জন্য অবশ্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ও নির্মাতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভও কম দায়ী নয়। অযত্ন অসচেতনেতায় ফেলে রাখা হয়েছিল কালজয়ী অনেক সিনেমা। ফিল্ম আর্কাইভ কঠোর না হওয়ায় সংরক্ষণে নেই সেসব সিনেমা।
যার ফলশ্রুতিতে চিরতরে হারিয়ে গেছে সেসব সিনেমা। উদাহরণ টানলে ‘চাঁদনী’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘দ্য রেইন’, ‘কসাই’, ‘অংশীদার’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘জিঘাংসা’, ‘আকাশ আর মাটি’সহ বেশ কিছু সিনেমা হারিয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে গুলিস্তান বিল্ডিংয়ে। যেখানে প্রযোজনা সংস্থার অফিস ছিল। নব্বই-এর দশকে যা অগ্নিকাণ্ডে বস্মিভুত হয়ে পুড়ে যায়। আজ যদি ফিল্ম আর্কাইভে সে সব ছবি জমা থাকতো তাহলে ধ্বংস হয়ে যেত না ছবিগুলো।
এদিকে, ২০১৩ সালে ডিজিটাল ছবি নির্মাণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এদের কয়েকজন নির্মাতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের প্রায় সবারই একই বক্তব্য, আর্কাইভ যে ফরমেটে ছবি জমা দিতে বলে অর্থাৎ হার্ড ড্রাইভ বা হার্ডডিস্কে যা একেবারে নিরাপদ নয়। এই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে আর্কাইভে ছবি জমা দিলে তা কপি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ছবি জমা দেয়ার নিয়ম এবং এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনার ওপর কড়াকড়িও নেই।
তাছাড়া ২০০৫ সালের কপিরাইট আইনে স্পষ্ট বলা আছে, ছবি নির্মাণের পর সংরক্ষণের জন্য অবশ্যই একটি কপি নির্মাতাকে ফিল্ম আর্কাইভে জমা দিতে হবে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট নির্মাতার দুই বছরের জেল এবং সে সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হবে। এদিকে, ফিল্ম সেন্সর বোর্ডকেও বলা হয়েছে, যদি ছবি সেন্সরের পর কোন নির্মাতা আর্কাইভে জমা দেয়ার জন্য বলা হয় এবং ওই নির্মাতা আগে কোনো ছবি নির্মাণ করে থাকলে তা আর্কাইভে জমা দেয়া হয়েছে মর্মে কাগজপত্র দেখাতে হবে। কিন্তু এসব আইনের তোয়াক্কা কে করে?
তবে ফিল্ম আর্কাইভ সূত্রেও জানা গেছে, এই ধরণের নির্মাতা (অপরাধী) অনেকের কাছে একাধিকবার শুধু চিঠিই নয়, সরাসরি লোক পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। পুরাতন যেসব সিনেমা হারিয়ে গেছে, সেসব সিনেমার প্রযোজক বা নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলা করাও সম্ভব হয় না। কারণ সবাই সিনিয়র চলচ্চিত্রের। নতুনদেরও আগ্রহ নেই। ধরে বেধে আইন করে কোনো উপায় হবে না বলে মনে করেন না সংশ্লিষ্ঠরা (যারা আর্কাইভের সঙ্গে জড়িত)।
সিনেমা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য সারাবিশ্বে ফিল্ম আর্কাইভ বা ফিল্ম মিউজিয়াম রয়েছে। আর আমাদের দেশে (বাংলাদেশ) ফিল্ম আর্কাইভ ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পর্যন্ত যেসব সিনেমা সংগ্রহ করা হয়েছে তার মধ্যে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কিংবা অনুদানের ছবির সংখ্যাই বেশি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ও আলোচিত ছবি হলো ‘দুই দুয়ারী’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘কিত্তণখোলা’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘গেরিলা’, ‘দুরত্ব’, ‘মেহের নিগার’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘আহা’, ‘কাবুলি ওয়ালা’, ‘ঘানি’, ‘নিরন্তর’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘শংখনাদ’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘অবুঝ বউ’, ‘গঙ্গাযাত্রা’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’, ‘মনের মানুষ’, ‘গহীনে শব্দ’, ‘দিপু নাম্বার টু’, ‘মৃত্তিকা মায়ার’, ‘জালালের গল্প’, ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘প্রিয়া তুমি সুখি হও’, ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘চকোরী’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘ঝড়ের পাখি’, ‘সাধারন মেয়ে’ উল্লেখযোগ্য।