কেজিবি: দূর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা
গোয়েন্দা বা গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে ছোটবেলা থেকেই মনে কৌতুহল ঘুরপাক খায়। অনেকে তো আবার গোয়েন্দা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে। এই কৌতুহলের পিছনে অবশ্য গোয়েন্দা উপন্যাস এবং সিনেমাগুলো প্রভাব ফেলে। গোয়েন্দা সংস্থা নিয়েও থাকে হাজারো প্রশ্ন।এসকল প্রশ্নের একটি হল কোন গোয়েন্দা সংস্থা সবচেয়ে দূর্ধর্ষ? বর্তমান পৃথিবীর কথা চিন্তা করলে ইজরাইলের মোসাদ বা মার্কিন সিআইএ কেই সবচেয়ে দূর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা বলা যায়।কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন ছিল।তখন সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি’র দাপট ছিল পুরো পৃথিবীতে। রাশিয়ান এই গোয়েন্দা সংস্থা তাদের গোয়েন্দাগিরির জন্য যতটা না বিখ্যাত ছিল তার থেকে বেশি তাদের নৃশংস সব উপায়ের জন্য কুখ্যাত ছিল।তাহলে কেমন ছিল এই সংস্থা?কীভাবেই বা প্রতিষ্ঠিত হয়? আর কীভাবেই বা এর সমাপ্তি ঘটে?
কেজিবি রুশ ভাষায় “কমিটেট গোসুদারসভেনি বেজোপানস্টি” যার বাংলা অর্থ রাষ্ট্র সুরক্ষা কমিটি। কেজিবির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৫৪ সালে তখনকার সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুষচেভ এর তত্ত্বাবধানে।কেজিবি মূলত এর উত্তরসূরি এনকেজিবি এর মত করেই তৈরি করা হয়েছে।সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা ক্রুষচেভ ক্ষমতায় এসে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্টালিন শাসনকালের সবকিছু পরিবর্তন করেন।এনকেজেবি থেকে কেজিবি প্রতিষ্ঠাও এই বড় পরিবর্তনের একটি অংশ ছিল। কেজিবি এর কার্যালয় ছিল মস্কোর লুবাঙ্কা স্কয়ার।কেজিবি এর দু’টি ভাগ ছিল।এক ভাগ দেশের অন্তর্গত সকল সমস্যা নিয়ে কাজ করত।অন্যভাগ কাজ করত আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে।এছাড়াও রাশিয়া ছাড়া সোভিয়েত ব্লকের অন্যান্য দেশগুলোর জন্য কেজিবি এর নিজস্ব বিভাগ ছিল।যেগুলো অন্য নামে কেজিবি এর তত্ত্বাবধানেই কাজ করত।তো কি ছিল এর কাজ?
কেজিবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্নায়ু যুদ্ধের উত্তেজনাময় সময়ে। মার্কিনদের সঙ্গে টক্কর দেয়া এবং নিজ দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র তথা সরকারের প্রতিরক্ষা দু’টিই ছিল কেজিবি’র মূল উদ্দেশ্য।এই দুই উদ্দেশ্য সফলের জন্য কেজিবি’র এজেন্টরা নিরিলস পরিশ্রম করেছিল।আন্তর্জাতিকভাবে কেজিবি মূলত বিভিন্ন দেশের সরকারের স্পর্শকাতর তথ্য সংগ্রহ করত।এজন্য কেজিবি বিভিন্ন দেশের সরকার এবং সামরিক বাহিনীর নেতাদের টার্গেট করত বিভিন্ন উপায়ে এদেরকে মেনুপুলেট করে বা ব্লাকমেইল করে এসকল তথ্য জোগাড় করত। তাছাড়াও আন্তর্জাতিক মার্কেটে সোভিয়েত অস্ত্র ব্যবসার প্রসারেও কেজিবি কাজ করত।কেজিবি সবচেয়ে সফলভাবে কাজ করেছিল বিভিন্ন দেশের সরকার পতনের মাধ্যমে সেসকল দেশে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায়।
ধারণা করা হয় কিউবায় সরকার পতন এবং সমাজতান্ত্রিক দেশে পরিনত করতেও কেজিবি এর হাত ছিল।এছাড়াও ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল কেজিবি’র ভিয়েতনাম যোদ্ধাদের অস্ত্র সাপ্লাই ও ট্রেনিং দেয়া।এমনকি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে সাহায্যতেও কেজিবি এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।কেজিবি মার্কিন মিলিটারি এবং খোদ সিআইএ তেও নিজেদের গোয়েন্দা প্রেরণ করতে সক্ষম হয়। এমনই এক গোয়েন্দা ছিলেন মার্কিন নেভাল অফিসার জন এন্থোনি ওয়াকার। ১৯৬০ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত এই কেজিবি সদস্য অনেক স্পর্শকাতর মিলিটারি টেকনোলজির তথ্য সোভিয়েত ইউনিয়নে পাচার করেছিলেন।সিআইএ’র একজন কেজিবি এজেন্ট এলড্রিচ এইমস।তিনি সিআই’র বিভিন্ন এজেন্টের তথ্য দিয়ে কেজিবিকে সাহায্য করেছিল। এছাড়াও ইন্টারনেশনালি বিভিন্ন হাই প্রোফাইল নেতার হত্যার পিছনেও কেজিবি’র হাত রয়েছে।এমনকি মার্কিন প্রসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যায়ও কেজিবি এর হাত আছে বলে ধারণা করা হয়।
কেজিবি আন্তর্জাতিকভাবে অপারেট করলেও সোভিয়েত মাটিতেও কেজিবি এর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল।সোভিয়েত ইউনিয়নে রাজনীতি থেকে শুরু করে নেতাদের এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রতিরক্ষা সকল কাজেই কেজিবি সক্রিয় ছিল।সোভিয়েত ব্লকের সকল দেশেই কেজিবি এসকল কাজ করত। তাছাড়াও সোভিয়েত নীতি নির্ধারনেও কেজিবি কর্মকর্তারা সাহায্য করত।তবে কেজিবি সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে কাজের জন্যই।অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর থেকে কেজিবি এর কাজের ধারা ছিল অনেক বেশি নৃশংষ। সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সকল বিদ্রোহে কেজিবি কঠোর হাতে দমন করেছিল।চেচেনদের বিদ্রোহে কেজিবি অনেক চেচেন নেতা এমনকি তাদের পরিবারদের ও নৃশংস উপায়ে হত্যা করেছিল।এছাড়াও চেক প্রজাতন্ত্রের যুদ্ধে গনহত্যায়ও কেজিবি এর হাত আছে।আফগান সোভিয়েত যুদ্ধেও দেখা যায় কেজিবি এর নৃশংস অংশগ্রহণ।এছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে অন্য রাজনীতিক মতে ও ধর্মে বিশ্বাসীদেরকে অত্যাচার, শ্রমিক ক্যাম্পে প্রেরণ এবং নির্বিচারে হত্যার জন্য কেজিবি কুখ্যাত।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই কেজিবিকে খারিজ করা হয় এবং সকল কেজিবি এজেন্টকে বরখাস্ত করা হয়।নবগঠিত রাশিয়ায় নতুন গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু কেজিবি’র প্রভাব এখনো রাশিয়ায় বিদ্যমান।এমনকি রাশিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান ভ্লাদিমির পুতিনও একজন কেজিবি এজেন্ট ছিলেন।